দিল্লীতে ঠিক হয়েছিল আমি দুদিনের মধ্যে করাচীর কাজ শেষ করব এবং বুধবার সন্ধ্যার প্লেনে বম্বে গিয়ে রাত্রেই এয়ার ইণ্ডিয়া ফ্লাইটে লণ্ডন রওনা হব। কিন্তু করাচীর পরিস্থিতি এমনই জটিল হয়ে উঠেছিল যে, রবিবার কেন, সোমবার-মঙ্গলবারের রিজার্ভেশনও বাতিল করতে হলো। শেষ পর্যন্ত বম্বে হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল করতে বাধ্য হলাম। স্থির হলো বুধবার মাঝরাতে প্যান-আমেরিকান ফ্লাইটে লণ্ডন যাব এবং শুক্রবার সকালে এয়ার ইণ্ডিয়ার ফ্লাইটে নিউইয়র্ক।
এয়ারপোর্টে এসে কাস্টমস পাশপোর্ট চেক করিয়ে আমাকে ট্রানজিট লাউঞ্জের একপাশে বসানো হলো। একটু দূরে একজন পুলিশ অফিসারকে একটু অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট খেতে দেখলাম। বুঝতে কষ্ট হলো না, আমার প্রতি নজর রাখার জন্যই প্রভুর আবির্ভাব। করাচীর আগে প্যান-আমেরিকানের এই প্লেনটি কলকাতায় থেমেছিল। কিন্তু ট্রানজিট লাউঞ্জে একজনও কলকাতার প্যাসেঞ্জার দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, কলকাতার যাত্রীরা বিমান থেকে নামার অনুমতি পাননি।
প্লেনের ডিপারচার অ্যানাউন্সমেন্ট হলে এয়ার লাইন্সের একজন গ্রাউণ্ডস্টাফ আমাকে সর্বাগ্রে প্লেনে যেতে বললেন। ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হলো না। সামনের সিঁড়ি বেয়ে কেবিনে ঢুকে দেখলাম পূর্বের পুলিশ অফিসারটি আগে থেকেই আমাকে অভ্যর্থনা কবার জন্য সেখানে উপস্থিত।
কেবিনে আমি ছাড়া আর মাত্র দুজন প্যাসেঞ্জার ছিলেন। চীফ স্টুয়ার্টকে বলে আমি আমার নির্দিষ্ট সীটটি ছেড়ে একেবারে পিছনের সারির ধারের সীটটিতে বসলাম।
কেমন যেন আনমনা হয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। নানা চিন্তায় টেরই পাইনি কখন প্লেন ছেড়েছে, কখন আরব সাগরের উপর দিয়ে বেইরুটের দিকে ভেসে চলেছে আমাদের বিমান। আবছা আলোয় হঠাৎ একটা শিশুকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে আমার যেন সংবিৎ ফিরে এলো। কিছুক্ষণ শিশুটিকে আপন মনে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। আরও কিছু সময় কেটে গেল। তারপর আস্তে তুড়ি দিয়ে বাচ্চাটিকে ডাক দিলাম! রাত্রির নিস্তব্ধতায় আমার প্রায় নীরব নিমন্ত্রণে শিশুটির ঈষৎ চাঞ্চল্য বন্ধ হলো। একটু দ্বিধা, একটু সঙ্কোচে সে আমার থেকে একটু দূরে থমকে দাঁড়াল! কয়েক মিনিট দুজনেই দুজনকে দেখলাম। আরো দুচার মিনিট কেটে গেল। আমি ধীরে একটু এগিয়ে গেলাম। ভাল করে দেখলাম। বেশ ভাল লাগল। মনে হলো পশ্চিম পাকিস্তানেরই হবে; তা নয়তো এত ফর্সা, এত সুন্দর হয় কি!
অতি সন্তর্পণে আমি শিশুটির একটি হাত ধরলাম। প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমারে কিয়া নাম হ্যায় বেটা?
কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গে মোটা মোটা বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে আমার দিকে তাকাল।
মিনিট খানেক বাদে আমি আর-একবার জিজ্ঞাসা করলাম, বেটা তুমারা নাম বাতাও!
কয়েক মুহূর্ত পরে ধীরে ধীরে শিশুটি আধো-আধো স্বরে আমাকে চমকে দিয়ে বলল, আপনি কি বলছেন?
এই কদিনে করাচী আমার মনটাকে তিক্ত করে দিয়েছিল। সিকিউরিটি কাউন্সিলের আগামী দিনগুলির চিন্তায় মন কম উদ্বিগ্ন ছিল না। মাঝরাতে প্লেনের মধ্যে এই শিশুটির কচি মুখে বাংলা কথা শুনে যেন একটা দমকা হাওয়ায় মনের মালিন্য সব ধুয়ে-মুছে গেল। হাসির রেখা ফুটে উঠল আমার মুখে।
হাত ধরে আদর করে কাছে টেনে নিলাম শিশুটিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম তোমার?
উজ্জ্বল দুটি মিষ্টি কচি চোখের দৃষ্টি আমার সারা মুখের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিয়ে বললো, আমার নাম স্বপন।
একটি মুহূর্ত থেমে আমাকে আবার প্রশ্ন করল, তোমার নাম কি?
স্বপন নামটা শুনে হঠাৎ অনেকদিন পর ভুলে-যাওয়া অতীতের একটা স্বপ্নের কথা মুহূর্তের জন্য আমার সারা মনকে আচ্ছন্ন করে দিল।
চিন্তার অবকাশ পেলাম না। স্বপন আমার হাতটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, বল না, তোমার কি নাম?
হাসি মুখে উত্তর দিলাম, আমার নাম তাপস।
আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে স্বপন ছুটে গেল টুরিস্ট ক্লাসের দিকে।
স্বপন চলে গেল, কিন্তু অতীত দিনের স্মৃতি স্বপ্নের মেঘ আমার মনের আকাশ আচ্ছন্ন করে দিল। ভুলে গেলাম কাশ্মীর সমস্যা, আসন্ন সিকিউরিটি কাউন্সিলের অধিবেশনের কথা; ভুলে গেলাম আজকের আমাকে, ভুলে গেলাম ইণ্ডিয়ান হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী তাপস সেনকে।
…বাবা মারা যাবার পর কাকিমার কৃপায় তাপসের পক্ষে কাকার সংসারে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আর একটা দিনও নষ্ট করেনি। পাটনায় কাকা-কাকিমাকে প্রণাম করে চড়ে পড়ল ট্রেনে। চলে এলো কলকাতায় মাসিমার কাছে। পিতৃ-মাতৃহীন তাপসকে আপন সন্তানজ্ঞানে মাসিমা নিজের সংসারে ঠাঁই দিলেন।
ফার্স্ট ডিভিসনেই পাস করল তাপস। ভর্তি হল স্কটিশ চার্চে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দুই টিউশনিও যোগাড় করে নিল নিজের খরচপত্র চালাবার জন্য। মাসিমা ও মেসোমশাই দুজনে আপত্তি করেছিলেন। তাপস বলেছিল, পরিশ্রম করে আয় করার মধ্যে একটা আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি আছে। তাছাড়া আজে বাজে সময় নষ্ট না করে দুটি ছাত্র পড়ালে ক্ষতি কি? মাসিমা মেসোমশাই আর আপত্তি করেননি।
জনক রোড থেকে স্কটিশ চার্চে যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। দশটা নাগাত বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেক মার্কেটে এসে ২বি বাস ধরে তাপস রোজ কলেজ যায়। আবার চারটে নাগাত রওনা হয়ে পৌনে পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসে। ঐ সময় ২বি বাসে স্কটিশ বেথুনের অনেক ছেলেমেয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করে। বেশ কয়েক মাস পরে তাপস আবিষ্কার করল পরাশর রোড থেকে বেরিয়ে একটি মাত্র মেয়েই প্রায় নিত্যই ওই বাসে বেথুনে যায়, আসে। বছর খানেক পরে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখে শুধু একটু হাসির রেখা ফোটাত। কিন্তু তার বেশী নয়।