আমি মাথা নিচু করে সব শুনলাম। আরেকবার রাষ্ট্রদূত চতুর্বেদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
দুটি সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমার বিদায় সংবর্ধনার পালা শুরু হলো। আমি ব্যাচিলার বলে সর্ব প্রথম সংবর্ধনা জানাল ইণ্ডিয়ান অ্যাম্বাসী ব্যাচিলার্স ইণ্ডিয়ান-এর তরফ থেকে। ইউনিয়নের তরফ থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত শিল্পী রেজাদ মহম্মদের আঁকা একটা অপূর্ব সুন্দরী চীনা মেয়ের পেন্টিং আমাকে উপহার দেওয়া হলো। এই আশা নিয়ে ব্যাচিলান ইউনিয়ন আমাকে এই উপহার দিয়েছিল– এই চীনা সুন্দরী আমার কৌমার্যকে চীনে অটুট রাখতে অনুপ্রাণিত করবে। চমৎকার!
পরবর্তী অনুষ্ঠানে মেয়েরা আমাকে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন। তারপর স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন, ডিপ্লোম্যাটিক স্টাফরা এবং সবশেষে অ্যাম্বাসাডর চতুর্বেদী বেশ জাঁকজমকভাবে আমাকে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন। ইন্দোনেশিয়ার ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার ছাড়াও এশিয়া আফ্রিকা গোষ্ঠীর জন পাঁচ-ছয় রাষ্ট্রদূত ও নানা দেশের কয়েক ডজন সিনিয়ার ডিপ্লোম্যাট এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।
তারপর একদিন সকালে সত্যিই আমি জাকার্তার মাটি ছেড়ে পাড়ি দিলাম সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল আগেই বুক করা ছিল। পারা লেবার এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের কমিশনের মিঃ রাও-এর সঙ্গে হোটেলে এসেই আবার বেরিয়ে পড়লাম বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে।
আমরা একদল মিলে গেলাম সিঙ্গাপুরের অতি খ্যাত নাইটক্লাব –সিভিউ হোটেলের চিকেন ইন-এ। পরের দিন কিছু মার্কেটিং করলাম। ন্যাশনাল মিউজিয়মের ধার থেকে কিছু চামড়ার জিনিস কিনে হাই স্ট্রীট-অৰ্চার্ড স্ট্রীট থেকে কিছু জামা-কাপড় ও একটা ভাল জাপানী ট্রানজিসটার রেডিও কিনে হোটেলে ফিরলাম লাঞ্চের সময়। তারপর লাঞ্চ খেয়েই রওনা হলাম এয়ারপোর্ট। এলাম হংকং।
কাইতাক এয়ারপোর্টে আমার পুরনো সহকর্মী ইন্দ্রজিত সিং-এর হাতে কতকগুলি জরুরী সরকারী কাগজপত্র পেলাম। পিকিং যাবার আগে দিল্লী থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারী কতকগুলি কথা জানিয়েছেন। মাসিমারও একটা চিঠি এসেছিল ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে। মাসিমার চিঠিতে জানলাম লীনার ছেলে হয়েছে।
পরের দিন ভোরে উঠেই রওনা হলাম চীন-হংকং সীমান্তের দিকে। সীমান্ত পার হলাম। ওপারে গিয়ে ট্রেনে চড়ে গেলাম ক্যান্টন; তারপর প্লেনে পিকিং।
চারটি বছর প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো কেটে গেল। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত একটা অব্যক্ত চাপা উত্তেজনার মধ্যে কাটত আমাদের সবার। ছুটি তো দুরের কথা, একটি দিনের জন্যও বিশ্রাম করার অবকাশ পাইনি। প্রতিদিনই একটা না একটা গুরুতর সমস্যা নিয়ে কেটেছে পিকিং-এর দিনগুলি।
শেষে আমার পিকিংবাসের পালাও একদিন শেষ হলো। বদলী হলাম করাচী। দিল্লীতে আমার এক বন্ধু সেক্রেটারীকে লিখলাম, কি ব্যাপার? আমাকে এক ট্রাবলস্পট থেকে আর এক ট্রাবলস্পটে কেন বদলী করা হচ্ছে? উত্তর এলো, সাউথ ব্লকের সারা ফরেন মিনিষ্ট্ৰীতে নাকি কৃতী ডিপ্লোম্যাট বলে আমার খুব সুনাম এবং সেজন্যই জার্কাতা থেকে পিকিং, পিকিং থেকে করাচী।
তবে পিকিং থেকে করাচী যাবার পথে একমাসের ছুটি জুটেছিল আমার অদৃষ্টে! মাসিমার চিকিৎসার একটু সুব্যবস্থা করতে না করতেই আমার ছুটি শেষ হয়ে এলো। কয়েকদিন পরে রওনা হলাম দিল্লী। দিন চার-পাঁচ ফরেন মিনিস্ক্রীতে আলাপ-আলোচনা করার পর চলে গেলাম করাচী।
সরকারী কাজ-কর্মে যথেষ্ট বিড়ম্বনা ভোগ করতে হলেও করাচীর দিনগুলো মোটামুটি ভালই কাটছিল। পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে অনেক বাঙালী আছেন। পাকিস্তান রেডিওতেও বাঙালীর সংখ্যা কম নয়। এদের অনেকের সঙ্গেই বেশ একটা হৃদ্যতার সূত্র গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যাবেলায় মনসুর আলির বৈঠকখানায় গানের আসর বসত। মনসুরের ভাটিয়ালী, মিসেস খাতুনের রবীন্দ্র সঙ্গীত, আমাদের হাই কমিশনের মিঃ রায়ের মেয়ে বন্দনার অতুল প্রসাদ-নজরুলের গান শেষ হতে না হতেই মনসুরের মা ডাক দিতেন, এসো বাবা, খাবার-দাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওদের ওখানে সরষে বাটা দিয়ে যে ইলিশমাছের ঝাল খেয়েছি, তা জীবনে ভুলব না। রবিবার দিন আড্ডা বসতো মিঃ রায়ের বাড়ি। শুরু হত তেলেভাজা চা দিয়ে, শেষ হতো বিয়ে বাড়ির মেনু দিয়ে।
বছর খানেক বাদে ছুটির আবেদন করলাম। আবেদন মঞ্জুর হলো। তিন মাসের ছুটিতে আমি কলকাতা গেলাম।
মাস দেড়েক বেশ কেটে গেল। খবরের কাগজের খবর পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম, করাচীর হাওয়া বদলে গেছে। বেশ অনুমান করতে পারছিলাম মনসুর আলির বাড়ির সাপ্তাহিক গানের আসর বন্ধ হয়েছে, রবিবার মিঃ রায়ের ড্রইংরুমে আর আড্ডা জমছে না। তারপর একদিন কাগজে দেখলাম, পাকিস্তান সিকিউরিটি কাউন্সিলে কাশ্মীর সমস্যা আলোচনার জন্য সরকারীভাবে অনুরোধ জানিয়েছে। দুদিন বাদেই দিল্লী থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারীর নিমন্ত্রণপত্র পেলাম, তাড়াতাড়ি দিল্লী এসো। ইণ্ডিয়ান ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে সিকিউরিটি কাউন্সিলে যেতে হবে।
একটি দিনের মধ্যেই কলকাতার পাট চুকিয়ে দিলাম। পরের দিন সকালের ফ্লাইটে গেলাম দিল্লী। এক সপ্তাহ ধরে আলাপ আলোচনা শলা-পরামর্শের পর গেলাম করাচী। ইণ্ডিয়ান ডেলিগেশন সোজা চলে গেল নিউইয়র্ক। ঠিক হয়েছিল করাচীতে কাগজপত্র ঠিকঠাক করেই আমিও সোজা নিউইয়র্ক যাব।