বৌদি একটু পা চালিয়ে যান প্যাণ্ডেলে। কিছুক্ষণ পরে নতুন কাপড়-জামা পরে পরিমলও ফিরে যায় প্যাণ্ডেলে। কাঁসর-ঘণ্টা-ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাখালদা আরতি করতে মত্ত, কলোনীর সবাই সে আরতি দেখতে মত্ত। মত্ত হয়নি পরিমল, হয়নি বৌদি। তাঁদের দুজনের সলজ্জ দৃষ্টি বার বারই মিলেছিল মাঝ পথে।
৬. জাকার্তা থেকে বদলী হলাম পিকিং
জাকার্তা থেকে বদলী হলাম পিকিং। মধ্যে তিন মাসের ছুটি। কিন্তু পিকিং দিল্লীর রাজনৈতিক মহাকাশে তখন কালবৈশাখীর ইঙ্গিত দেখা দিয়েছে। তিন মাসের হোমলিভ পাব কি না, সে বিষয়ে আমার বেশ সন্দেহ ছিল, কিন্তু তাই বলে পুরো ছুটিটাই বাতিল হবে, তা ভাবিনি। কলকাতায় কিছুদিন হৈ চৈ করে কাটাব বলে বন্ধু বান্ধবদের চিঠিপত্রও দিয়েছিলাম। মাসিমাকেও লিখেছিলাম। বেশ খোশ মেজাজেই ছিলাম। —
থার্ড সেক্রেটারী রঙ্গনাথন বিয়ে করে সবে জাকার্তা এসেছে। এম্বাসীর আমরা সবাই ওদের দুজনের অনারে বোগরে একটা প্রোগ্রাম ঠিক করলাম। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাটাচি কাপুর চাঁদা তোলা শুরু করে দিল, প্রেস অ্যাটাচি মুখার্জী আর মিসেস মুখার্জী চিত্রাঙ্গদার সিলেকটেড সিনের রিহার্সাল আরম্ভ করে দিলেন। ভাইস-কন্সাল যোশী বোগরের সব ব্যবস্থার ভার নিল।
দুসপ্তাহ প্রস্তুতির পর সেই শনিবার এলো। সকাল সাতটায় চানসেরার বিল্ডিং থেকে আমাদের কনভয় রওনা হলো। কেনি দুর্ঘটনার জন্য নয়, আনন্দের আতিশয্যে আধঘন্টার রাস্তা যেতে আড়াই ঘণ্টা লাগল। পথে কনভয় থামিয়ে কাপুর ও জন চারেক ভাংড়া ডান্স দেখাল, রঙ্গনাথন ও মিসেস রঙ্গনাথনকে দিয়ে এক লাভসিনের শট তুলল সিনহা তার মুভিতে এবং আরো অনেক কিছু হলো।
বোগরের ঐতিহাসিক বোটানিক্যাল গার্ডেনে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইস-কন্সাল যোশী যা খেল দেখাল, তা ভোলবার নয়। তিনজন স্টাফকে এয়ার-আর্মি-নেভাল এ-ডি-সি সাজিয়ে রিসিভ করল মিঃ ও মিসেস রঙ্গনাথনকে, একদল স্কাউট ছেলে-মেয়েদের দিয়ে গার্ড অব অনার প্রেজেন্ট করল, টেপরেকর্ডার বাজিয়ে মিলিটারী ব্যাণ্ডে জাতীয় সঙ্গীত শোনাল এবং সবশেষে নিজে মাথায় একটা গান্ধীটুপি চাপিয়ে ভারত সরকার ও ভারতবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা বক্তৃতাও দিল। জনচারেক সেকেণ্ড ও থার্ড সেক্রেটারী অভিজ্ঞ টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানদের মতো ছোটাছুটি করে অনুষ্ঠানটির মুভি তুলল।
দুপুরের ভোজনপর্বটাও বিচিত্র হলো। দক্ষিণ ভারতীয় মশালা দোসার সঙ্গে সম্বর এলো না, এলো বাঙালীদের মাছের ঝাল, পুরীর সঙ্গে এলো গুজরাটীদের ব্যাসনের ভাজা, পোলাও এলো সম্বরের সঙ্গে এবং এমনি মজাদার আরো অনেক কিছু। অপরাহ্নকালীন চায়ের পর শুরু হলো চিত্রাঙ্গদা। প্রথম দৃশ্য অভিনয় সবে শুরু হয়েছে এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে সিংহল ও ইউ-এ-আর অ্যাম্বাসাডরদেয় নিয়ে আমাদের অ্যাম্বাসাডর হাজির। যোশী কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তিনজন এডিসি হাজির করল, স্কাউটদের আবার টেনে এনে লাইন করে দাঁড় করাল। আবার রিসেপশন, গার্ড অব অনার, আবার টেপ রেকর্ডারে ন্যাশনাল অ্যানথেম বাজানো হলো। যোশী আবার গান্ধী টুপি চাপিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে তিনজন রাষ্ট্রদূতকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানালেন।
চিত্রাঙ্গদা অভিনয় শেষ হলো। হঠাৎ কোথা থেকে অকস্মাৎ হাজির হলো পাকিস্তান অ্যাম্বাসীর দুজন সেকেণ্ড সেক্রেটারী মনসুর আলি আর রহমান।
মনসুর আলি গাইল একটা গজল, রহমান আবৃত্তি করে শোনাল কতকগুলি উর্দু শের।
তিনজন রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে মিসেস রঙ্গনাথনকে একটা পোর্টেবল টেলিভিশন সেট প্রেজেন্ট করলেন ইউ-এ-আর অ্যাম্বাসাডর, স্কাউটদের আপ্যায়নের আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের রাষ্ট্রদূত এবং চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের অনারে সিংহলের রাষ্ট্রদূত একটা ডিনারে আমন্ত্রণ জানালেন উপস্থিত সবাইকে।
সূর্য অস্ত গেল। বোগরের মালভূমিতে বেশ আমেজি ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে সারাদিনের ক্লান্তি বিদায় নিল। আমাদের কনভয় আবার ফিরে এলো জাকার্তা।
পরের দিন সকালে অফিসে যেতেই রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠালেন।
গুড মর্নিং স্যার।
মর্নিং।
হাতে একটা রেডিও মেসেজ দিলেন!…ইনসট্রাক্ট ফার্স্ট সেক্রেটারী তাপস সেন প্রসিড পিকিং ডাইরেক্টলি স্টপ নো হোমলিভ বাট ওয়ান উইকস্ প্রিপারেটরী লিভ গ্রানটেড।…কোথায় তিন মাসের ছুটিতে কলকাতায় আনন্দ করব, তা নয়তো, তার পরিবর্তে মাত্র এক সপ্তাহের ছুটি!
অ্যাম্বাসাডর বললেন, আই অ্যাম স্যরি সেন। তুমি বলবার পর আমি নিজে ফরেন সেক্রেটারীকে একটা রেডিও মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তাতেও কিছু হলো না।
একটু থামলেন। আবার বললেন, পিকিং গিয়ে নিজের কাজকর্ম গুছিয়ে নেবার পর ছুটি নিয়ে একবার কলকাতায় ঘুরে এসো।
অ্যাম্বাসাডরকে আমি ধন্যবাদ জানালাম।
অ্যাম্বাসাডর বললেন, অনেক মিশনে অনেককে নিয়েই আমি কাজ করেছি, কিন্তু তোমার মতো সহকর্মী আমি বেশী পাইনি। ইনফ্যাক্ট তোমার মতো কলিগ পাবার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ইন এনি কেস, যে-কোন প্রয়োজনে তুমি আমাকে মনে করলে আমি সুখী হবে। তাছাড়া সামনের বছর তো আমি নিজেই মিনিস্ক্রীতে ফিরে যাব, তখন নিঃসঙ্কোচে তুমি আমাকে তোমার সুবিধা-অসুবিধার কথা জানালে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করতে পারব।