যে আকাশ-পথে পরিমল উড়ে গিয়েছিল, সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রাখালদা স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন পরিমল তাঁর আপন ভাই, দুজনে মিলে নতুন করে সোনার সংসার গড়ে তুলছেন।
রাত্রে রাখালদা ঘুমিয়ে পড়লে বৌদি পাশ ফিরে শুয়ে জানলার মধ্য দিয়ে শিউলি গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। ঠাকুরপো তো আমার চাইতে দু-তিন বছরের বড়ই হবে। ওর সঙ্গেও তো আমার বিয়ে হতে পারত। আমিও ঐ আকাশ দিয়েই প্লেনে করে উড়ে যেতাম বিলেত, আমেরিকা, রাশিয়া ও আরো কত দেশ! কত সুখেই আমি থাকতাম! কত আদর, কত ভালবাসাই না পেতাম! কত বড় বড় লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হতো, পরিচয় হতো! ঠাকুরপোর মতো আমাকে নিয়েও সারা কলোনীর সবাই মেতে উঠত।
ঐ একই আকাশের তলায় মস্কোয় নিঃসঙ্গ ডিপ্লোম্যাট পরিমল বোস স্বপ্ন দেখত, এই জীবনে যদি ঠিক আর একটা বৌদি পেতাম, তবে তাকে বিয়ে করে জীবনটাকে পূর্ণ করতাম। যার সঙ্গে মনের এত মিল, যার কাছে আমি আত্মসমর্পণ করে এত আনন্দ, এত তৃপ্তি পাই, তাকে যদি পেতাম এই জীবনে…
মুক্ত বিহঙ্গের মতো মন আরো কতদূর যেন ভেসে চলে যায়।
পরিমল আবার হোমলিভে আসে, আবার দমদমের ভীড় ঠেলে যায় বৌদির কাছে। আবার কটি দিন হাসিতে, খেলায়, আনন্দে দুজনের মন মেতে ওঠে। বৌদির গণ্ডীবদ্ধ জীবনে হঠাৎ জোয়ার আসে, পরিমলের সংযত জীবনে একটু যেন চঞ্চলতা আসে।
এরই ফাঁকে মা বিয়ের কথা বললে পরিমল বলে, বিলেত আমেরিকায় গেলে ছেলেরা ভাল থাকে না। অযথা বিয়ে দিয়ে কেন একটা মেয়ের সর্বনাশ করবে বল?
তুই আজকাল ভারী অসভ্য হচ্ছিল, মা মৃদু ভর্ৎসনা করেন তাঁর ছেলেকে।
পরিমল আবার ঐ একই আকাশ দিয়ে উড়ে চলে যায়। ঐ আকাশের দিকে তাকিয়েই আবার দুটি মন, প্রাণ ভেসে চলে যায় অচিন দেশে। একজন মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্র নীল নদীর পাড়ে কায়রোয়, আর একটি প্রাণ কলকাতা মহানগরীর উপকণ্ঠে, কিন্তু সবার অলক্ষ্যে দুটি প্রাণ একই স্বপ্ন দেখতে দেখতে মিলিত হয় ভূমধ্য মহাসাগরের পাড়ে কোনও এক দেশে। বৌদির সঙ্গে তার অনেক মিল পরিমল জানে, বৌদিও জানে ঠাকুরপোর মনের সঙ্গে তাঁর অনেক মিল। কিন্তু দুজনের কেউই জানে না একই আকাশ প্রতিদিন মাঝরাতে তাদের দুজনকে হাতছানি দিয়ে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নময় এক রাজ্যে।
শেষরাতের দিকে বৌদির চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। ঘুমের ঘোরে অচৈতন্য অবস্থায় রাখালদা বৌদিকে একটু নিবিড় করে কাছে টেনে নেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন বৌদির বেশ লাগে সে নিবিড় স্পর্শ।
পরিমলের মন মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করতে চায়, আবার মাঝে মাঝেই ভেঙ্গে পড়ে। বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে বৌদির ফটোটা তুলে নেয়, অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কখন যে চোখের পাতা দুটো ভিজে ওঠে, তা টের পায় না। নিজের অজ্ঞাতসারেই বলে, বীথি! ইচ্ছা করে না আমার কাছে ছুটে আসতে? আদর করতে? ভালবাসতে? ইচ্ছে করে না–
হঠাৎ রাখালদার কথা মনে হয়। পরিমলের মাথাটা ঘুরে ওঠে।
তিন মাসের ছুটিতে আবার পরিমল এলো কলকাতা। দীর্ঘদিন পর দুর্গাপূজা দেখবে এবার। দেশহিতৈষী কলোনীর ছেলেরা মাতোয়ারা হয়ে উঠল আনন্দে। মা-বাবা, রাখালদা-বৌদি সবাই খুশি। পূজার এক মাস বাকী, কিন্তু তবুও একটি দিন নষ্ট করল না পরিমল। মেতে উঠল পুজার উদ্যোগ করতে। যশোর রোডের পর বিরাট ফেস্টুন টাঙান হলো, দেশহিতৈষী কলোনী সার্বজনীন দুর্গোৎসব। ব্যাপকভাবে উদ্যোগ আয়োজন হলো পূজার।
ভাদ্দুরে গোমড়ামুখো আকাশ হেসে উঠল, শরতের আকাশ হাসি মুখে দেখা দিল। বৌদির শোবার ঘরের পাশের শিউলি গাছটা ফুলে ভরে উঠল, গন্ধে মাতোয়ারা করল বৌদির মন। দশভূজা মা দুর্গা এলেন তার দরিদ্র সন্তানদের ঘরে।
নবমী পূজার দিন আরতি আরম্ভ হলে পূজা প্যাণ্ডেলেই মা বকাবকি শুরু করে দিলেন পরিমলকে। তুই কি আশ্চর্য ছেলে বল তো? এতদিন পর পূজায় বাড়ী এলি অথচ এতবার বলা সত্ত্বেও একটি বারের জন্যও নতুন জামা-কাপড়টা পরলি না?
বাবা বললেন, মার পূজার এই শেষ দিনে নিজের মাকে দুঃখ দিও না।
পাশ থেকে রাখালদা বললেন, ছিঃ খোকন! কেন এই সামান্য একটা ব্যাপারে মাসিমা-মেসোমশাইকে কষ্ট দিচ্ছ। যাও দৌড়ে গিয়ে নতুন কাপড় পরে এসো। আরতি শেষ হবার পর পরই তো আবার থিয়েটার শুরু করতে হবে।
বাধ্য হয়ে পরিমল বাড়ীর দিকে পা বাড়াল।
রাখালদাদের শিউলি গাছের তলা দিয়ে এগিয়ে এসে পুকুর পাড়ে আসতেই হঠাৎ বৌদির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
কি গো বৌদি, তুমি এখনও আরতি দেখতে যাও নি?
আরতির পর একেবারে থিয়েটার দেখে ফিরব বলে সব ঠিকঠাক করে বেরুতে বেরুতে দেরী হয়ে গেল।
গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছিল পরিমলের মুখে। বৌদি এক ঝলক দেখে নেন। জিজ্ঞাসা করেন, তুমি এখন প্যাণ্ডেল ছেড়ে এদিকে এলে?
মাথায় একটু দুষ্ট বুদ্ধি আসে পরিমলের। বলে, তোমাকে একটু একা পাব বলে।
বৌদির মুখে একটু দুষ্টু হাসি খেলে যায়। একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে পরিমল এগিয়ে যায় বৌদির কাছে। মুহূর্তের জন্য দুজনেই মৌন হয়।
পরিমল যেন কেমন করে তাকায় বৌদির দিকে, বৌদি তাঁর স্বপ্নালু দৃষ্টি দিয়ে দেখেন ঠাকুরপোকে। দুজনেরই দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়েছিল একই সঙ্গে। হঠাৎ একটু হাওয়ায় মিষ্টি শিউলির গন্ধ ভেসে আসে। দুজনেই যেন মনে মনে মাতাল হয়ে ওঠে। এক টুকরো মেঘ ঢেকে দেয় শরতের চাঁদকে। সেই অন্ধকারে জ্বলে ওঠে দুজনের প্রাণের প্রদীপ। হারিয়ে যায় স্বপ্নরাজ্যের দেশে।