শুনে সবাই অবাক হয়েছিলেন। প্রথমে মা-বাবা ও রাখালদাকে প্রণাম করলেন। কলোনীর ছেলেমেয়েদের একটু আদর-টাদর করে চারপাশ তাকিয়ে নিলেন। বললেন, রাখালদা বৌদি আসেন নি?
রাখালদা একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন, এসেছে কিন্তু ভেবেছে হয়তো তুই ওকে চিনতে পারবি না বা চিনতে তোর প্রেস্টিজে বাধবে। তাই ঐদিকে লুকিয়ে আছে।
বৌদির কি মাথাটা পুরোপুরিই খারাপ হয়ে গেছে, এই কথা বলেই পরিমল ছুটে গিয়েছিল বৌদির কাছে।
প্রথমে একটু প্রাণভরে দেখেছিল তার বৌদিকে, একটু হেসেছিল। তারপর বলেছিল, আমার আজকাল ভীষণ অহঙ্কার হয়েছে। তুমি কোন্ সাহসে এয়ারপোর্টে এলে।
বৌদির মুখের পর দিয়ে বেশ একটা তৃপ্তির হাসির ঢেউ খেলে গেল। বৌদি এবার একটু হাসলেন। তোমার তো অহঙ্কার করার কারণ আছে ঠাকুরপো। দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, আজ তুমি কত বড় অফিসার, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে মেলামেশা কর। কত টাকা রোজগার কর; সুতরাং আমার মতো একটা অতিসাধারণ মেয়ের পক্ষে তোমার কাছে আসতে সঙ্কোচ হওয়া স্বাভাবিক।
ব্যস ব্যস আর ঢং কোরো না, বাড়ী চল।
বৌদি সেদিন মুখে এসব কথা বললেও মনে মনে অসম্ভব গর্ববোধ করতেন তার ঠাকুরপোর জন্য। এই কলোনীতে তো এতগুলো বৌ আছে, কিন্তু কই ঠাকুরপো তো আমার মত আর কাউকে ভালবাসে নি। আমিই তো ওর সব চাইতে প্রিয়, সব চাইতে নিকট ছিলাম। সেদিন দমদম এয়ারপোর্টে ঠাকুপোর ঐ কটি কথায় খুব খুশী হয়েছিলেন বৌদি। মনে মনে শান্তি পেয়েছিলেন এই ভেবে যে পরিমল বোস ডিপ্লোম্যাট হয়েও তার ঠাকুরপো আছে।
মস্ত বড় অফিসার হয়ে বিলেত আমেরিকা ঘুরে এসেও পরিমলের যে কোনই পরিবর্তন হয় নি, একথা বুঝতে দেশহিতৈষী কলোনীর একটি মানুষেরও কষ্ট হলো না। সেই ধুতি সেই গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে লেগে পড়েছিল কলোনীর কাজে।
প্ৰথম কদিন কি ভীষণ উত্তেজনা ও হৈ-চৈ করেই না কাটল। মা-বাবা, রাখালদা-বৌদি ও আরো কয়েকজনের জন্য অনেক জিনিষপত্র এনেছিল পরিমল। সে সব নিয়েও কম হৈ-চৈ হলোনা। টেপ রেকর্ডারে কথাবার্তা টেপ করিয়ে নিয়ে বাজিয়ে শোনালে উত্তেজনা প্রায় চরমে পৌঁছাল!
প্রফুল্লবাবু ও তার স্ত্রী পুত্রের কল্যাণে কলোনীর সবাইকে মিষ্টি মুখ করালেন। জনে জনে আশীর্বাদ করলেন পরিমলকে।
রাখালদা পরের দিন নিউইয়র্কের ফিফথ এভিনিউর বিখ্যাত দোকান আলেকজাণ্ডারের টেরিলিন প্যান্ট, বুশ শার্ট পরে অফিস গেলেন। সি-সি-এস অফিসের প্রায় সবাই জানল, পরিমল বোস ছুটিতে বাড়ী এসেছে। বৌদি কিন্তু লজ্জায় ফ্রেঞ্চ শিফন শাড়িটি পরলেন না। বললেন, না ঠাকুরপো, এ শাড়ী পরে বেরুলে সবাই হাসবে।
একদিন পরিমল বৌদিকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল। সেদিন ঠিকই শিফন শাড়ীটা পরেছিলেন। পরিমল জিজ্ঞাসা করেছিল, এ কি বৌদি সবাই হাসবে যে!
একটু হেসে বৌদি জবাব দিয়েছিল, ফরেন সার্ভিসের পরিমল বোসের সঙ্গে বেরুলে কেউ হাসবে না, বরং বলবে কি সিম্পল! তাই না ঠাকুরপো?
রিক্সা করে দমদম এয়ারপোর্টের মোড় অবধি এসে ট্যাক্সি ধরল পরিমল। তারপর সোজা ফেয়ারলি প্লেস বুকিং অফিসে। রাখালদা তো অবাক।
কি ব্যাপার রে খোকন?
কি আবার ব্যাপার। বৌদিকে নিয়ে সিনেমায় যাচ্ছি, তাই তোমাকে নিতে এলাম।
রাখালদা বললেন, নারে আমার অনেক কাজ। তোরাই যা। আমি আর তুই রবিবার যাব।
ঠাকুরপো, সি-সি-এস-এর জামাইকে অফিস ফাঁকি দিতে বলছ? ফেয়ারলি প্লেসে কাজ করে কিভাবে আনফেয়ার হয় বল।–বৌদি টিপ্পনী কাটলেন।
রাখালদা ঠাট্টা করে বললেন, আরে তুমি! এমন সেজেছ যে চিনতেই পারছি না।
পরিমল অনেক পীড়াপীড়ি করল। রাখালদা কানে কানে ফিস ফিস করে বললেন, এমন হঠাৎ কাজকর্ম ফেলে চলে যাওয়া ঠিক হবে না, তোরা আজকে যা। রবিবার আমরা তিনজনে একসঙ্গে যাব।
পরিমল বললো, ঠিক আছে। তাহলে শেষ পর্যন্ত তোমাদের রেলের ক্যান্টিনের ফিস ফ্রাই খাওয়াও।
রাখালদা ফিস ফ্রাই-এর অর্ডার দেবার পথে কানে কানে প্রায় সব সহকর্মীকে বললেন, ঐ হচ্ছে আমাদের খোকন। এখন বদলী হয়ে আমেরিকা থেকে রাশিয়া যাচ্ছে। বৌদিকে নিয়ে সিনেমা চলেছে।
প্রায় সবাই এক ঝলকে দেখে নিলেন পরিমলকে। কয়েকজন এসে আলাপও করেছিলেন, রাখালের কাছে আপনার কথা কত যে শুনেছি, তা বলবার নয় বলে।
সেদিন দুজনে সিনেমা দেখলেন, ঘুরলেন-ফিরলেন বেড়ালেন। রাত্রিতে বাড়ী ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বসে বসে অনেক কথা হলো দুজনে।
জানো বৌদি, তোমার জন্য ভীষণ মন খারাপ করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ছুটে আসি। একটু থেমে পরিমল বলে, অনেক মেয়ে দেখলাম, অনেকের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, কিন্তু কই তোমার মতো একটিও পেলাম না।
বৌদিও বলেছিলেন, তুমি তো তোমার দাদাকে ভালভাবেই জানো। উনি আমাকে ভালবাসেন। কিন্তু আমার মনের খোরাক জোগাবার দিকে তাঁর কোন নজর নেই। তাই তো তুমি চলে যাবার পর আমার বড় কষ্ট হয়।
ভূপেন বসু এভিনিউ পিছনে ফেলে ট্যাক্সি শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা ক্রশ করল। বৌদি আবার একটু বাইরে কি যেন দেখে নিলেন। বৌদি আবার বলেন, আজ কিন্তু আমার সব দুঃখ দুচে গেছে। তুমি যে এতবড় হয়েও, এতদেশ ঘুরে এসেও আমাকে ভুলে যাওনি, আমাকে যে ঠিক আগের মতনই ভালবাস, সেজন্য আমি খুব খুশি।
এমনি করে দেখতে দেখতে ছুটির দিনগুলি ফুরিয়ে আসে। পরিমল আবার একদিন দমদমের মাটি ছেড়ে উড়ে যায় আকাশে, চলে যায় মস্কো।