রাত্রে শুয়ে বৌদিকে বলেন, জানো খোকন ফার্স্ট ক্লাশে করে দিল্লী গেল।
সে কি গো?
রাখালদা একটু চুপ করেন। আবার বলেন, তাছাড়া, টিকিট কিনে যায়নি, সরকারী পাশে গিয়েছে। ফার্স্ট ক্লাশ তো খুব বড় বড় অফিসাররা পায়। তাই ভাবছিলাম খোকন বোধহয় বেড়াতে যায়নি, নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যাপারে গিয়েছে।
বৌদিও একটু চিন্তিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর কেউই কাউকে কিছু বলেন না।
দিল্লী থেকে পরিমলের পৌঁছানোর সংবাদ এলো। দিন দশেকের মধ্যে আবার কলকাতায় ফিরেও এলো। শুধু কুতবমিনার-লালকেল্লার গল্প করল; আর কিছু বললো না।
মাস তিনেক আবার আগের মতো সহজ সরল হয়ে কাটিয়ে দিল পরিমল। স্কুল, টিউশানি, কলোনীর লাইব্রেরী, পূর্ণিমা সম্মিলনী, আগমনী সংবাদ, পার্ক-রাস্তাঘাট ও ওয়েষ্ট বিনের দেখাশুনা আর বৌদিকে নিয়েই বেশ কাটাল।
ইতিমধ্যে খবরের কাগজে নাম বেরিয়েছে, কিন্তু তবুও কাউকে কিছু বলেনি। যেদিন স্কুলে রেজেষ্ট্ৰী ডাকে আসল চিঠিখানা হাতে পেল সেইদিন বাড়ী ফিরে সবাইকে জানাল সে ইণ্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে জয়েন করছে।
প্রফুল্লবাবু ও তার স্ত্রী আনন্দে চোখের জল ফেললেন। রাখালদা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন তার খোকনকে, কলোনীর ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আর বৌদি? আনন্দে আর উত্তেজনায় সবার অলক্ষ্যে পরিমলকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বাস কর ঠাকুরপো, আমি জানতাম তুমি একদিন জীবনে নিশ্চয়ই উন্নতি করবে। হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে মুখটা একটু ঘুরিয়ে নিলেন বৌদি। দুচোখ তাঁর জলে ভরে গেল। কি যেন বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। পরিমল সান্ত্বনা জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারল না। মনের মধ্যে এমন কান্না গুমরে উঠল যে তারও স্বর বেরুল না গলা দিয়ে।
দেখতে দেখতে দিনগুলি কেটে গেল। আবার একদিন দিল্লী মেলে চড়ল পরিমল। বাবা-মা, রাখালদা-বৌদি, কলোনীর একদল ছেলেমেয়ে ছাড়াও অনেক মাস্টার ও ছাত্ররাও এসেছিলেন বিদায় জানাতে। ঐ ভীড়ের মধ্যেই এক ফাঁকে বৌদি একবার একপাশে একটু আড়ালে নিয়ে কানে কানে বলেছিলেন, আমাদের ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না ঠাকুরপো?
সে কথা কি মুখে না বললে তুমি বুঝতে পার না?
কেমন যেন একটু ব্যাকুল হয়ে বৌদি আবার প্রশ্ন করেন, বিলেত আমেরিকা গিয়ে কি তুমি আমাকে ভুলে যাবে?
বিদায়বেলায় বিয়োগব্যথার ঝঙ্কার বেজে উঠেছিল পরিমলের সারা মনে। বললো, চেষ্টা করেও বোধহয় এজীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।
বৌদির সারা মনের আকাশে শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ জমে উঠেছিল, কিন্তু হঠাৎ তারই মধ্যে একটু বিদ্যুৎ চমকে একটু আলো ছিটিয়ে গেল। মুখে সামান্য একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বৌদি বললেন, সত্যি বলছ?
সত্যি বলছি।
সপ্তাহখানেক দিল্লীতে থেকে পরিমল গেল লণ্ডন। কেম্ব্রিজে তিন মাসের রিওরিয়েনটেশন কোর্স করে থার্ড সেক্রেটারী হয়ে চলে গেল ওয়াশিংটনে ইণ্ডিয়ান এম্বাসীতে। দুটি বছর কেটে গেল সেখানে। তারপর সেকেণ্ড সেক্রেটারী হয়ে মস্কোয়, কায়রোয়। তারপর আবার প্রমোশন। ফার্স্ট সেক্রেটারী হয়ে প্রথমে ইউনাইটেড নেশনস-এ, পরে লণ্ডন ইণ্ডিয়ান হাইকমিশনে। কর্মজীবনের এই চাঞ্চল্যকর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনও বিচিত্র পথে মোড় ঘুরেছে। অতীতের সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট করে দিয়েছে।
ফরেন সার্ভিসের সার্থক ডিপ্লোম্যাট হয়েও পরিমল পুরোপুরি মিশিয়ে দিতে পারেনি কূটনৈতিক দুনিয়ার আর পাঁচজনের সঙ্গে নিজের জীবন, অতীতের আদর্শ নিয়ে আজও ছিনিমিনি খেলতে শেখে নি সে। ওয়াশিংটনের পেনসিলভানিয়া এভিনিউ, মস্কোর রেড স্কোয়ার, লণ্ডনের পিকাডিলী সার্কাসের চাইতে মধ্যমগ্রামের দেশ হিতৈষী কলোনীকে আজও সে বেশী ভালবাসে। মিস অ্যালেন, মিসেস চোপরা, মিস চৌধুরী, মিস রঙ্গনাথন, মিসেস যোশীর অনেক আকর্ষণের স্মৃতি ছাপিয়ে মনে পড়ে শুধু বৌদিকেই। আশ-পাশের অনেক মানুষের চাইতে অনেক বেশী মনে পড়ে দেশহিতৈষী কলোনীর অর্ধমৃত মানুষকে। ওয়াশিংটন, মস্কো, কায়রো, নিউইয়র্ক, লণ্ডনকে ভাল লেগেছে, কিন্তু দেশহিতৈষী কলোনীর মতো এদের সঙ্গে কোন প্রাণের টান অনুভব করে নি। ফরেন সার্ভিসের সহকর্মী মিত্তিরের ভালবাসায় মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু রাখালদার শূন্য আসন পূর্ণ করতে পারে নি। তাইতো হোমলিভ পেলে একটি মুহূর্ত নষ্ট করে নি, ছুটে এসেছে কলকাতায়, মধ্যমগ্রামের দেশহিতৈষী কলোনীতে।
ওয়াশিংটন থেকে মস্কো বদলী হবার সময় তিন মাসের হোমলিভে ছুটে এসেছিল কলকাতা। প্রায় সারা দেশহিতৈষী কলোনীর সবাই এসেছিলেন দমদম এয়ারপোর্টে। কাস্টমস এলাকার বাইরে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। অন্যান্য সব প্যাসেঞ্জারের আগে বেরিয়ে এলো পরিমল। অনেকেই ফিস ফিস করে বলাবলি করেছিলেন, দেখছিস খোকনদার কি প্রেষ্টিজ।
রাখালদা বলেছিলেন, ওরে বাবা, হাজার হলেও ডিপ্লোম্যাট। খোকনের মালপত্তর ছোঁবার সাহস কোন কাস্টমস অফিসারের নেই।
সবাই একবাক্যে সে কথা স্বীকার করেছিলেন।
পরে অবশ্য পরিমল বলেছিল, আমাদের মতো যাদের ডিপ্লোম্যাটিক পাশপোর্ট থাকে তাদের সাধারণতঃ কাস্টমস কিছু বলে না। শুধু এদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই ডিপ্লোম্যাটরা এই সম্মান পান।