বৌদি হচ্ছে পরিমলের প্রাইভেট সেক্রেটারী। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র টাকাকড়ি জমা রাখে বৌদির কাছে। নিজের সংসারের টাকা-পয়সার কোন ঝামেলায় না থাকলেও পরিমলের অনেক সংসারের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় তাঁকে। তবুও ভাল লাগে তাঁর। নিজের সংসারের গণ্ডীবদ্ধ জীবনে পরিমল হচ্ছে তাঁর একমাত্র বাতায়ন এবং এই একটি বাতায়নের মধ্য দিয়েই তিনি বিরাট দুনিয়ার কিছুটা স্পর্শ, কিছুটা আনন্দ অনুভব করেন।
দিন এগিয়ে চলে।
পরিমল ইকনমিকসে অনার্স নিয়েই বিএ পাস করল। সারা দেশহিতৈষী কলোনীর সমস্ত মানুষগুলো আনন্দে আটখানা হয়ে পড়ল। পাড়ার ছেলেরা তাদের খোকনদাকে রিসেপশন দিল, পূর্ণিমা সম্মিলনীর মেয়েরা শাঁখ বাজিয়ে চন্দনের তিলক পরাল। এইসব কাণ্ডের মূল কিন্তু রাখালদা। রেজাল্ট বেরুবার দিন সবচাইতে আগে খবর নেন তিনি। কলেজ স্ট্রীট মার্কেট থেকে একটা চমৎকার ধুতি কিনে ট্যাকসি করে ছুটে এসেছিলেন কলোনীতে। চীৎকার করে সারা দুনিয়াকে জানিয়েছিলেন, পরিমল অনার্স নিয়ে পাস করেছে। বৌদিকে ঠেলে বের করে বলেছিলেন, ওগো, শীগগির সবাইকে খবর দাও আমাদের খোকন অনার্স নিয়ে পাস করেছে। উত্তেজনায় শুধু বৌদির ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। নিজে সারা কলোনী ঘুরে ছিলেন। গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, ইকনমিকসে অনার্স পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।
অনেকেই খেয়াল করলেন না কিন্তু বৌদি আর পরিমল দুজনেই খেয়াল করল যে বিয়ের পর এই প্রথম রাখাল সরকার অফিস কামাই করলেন।
শান্ত, স্নিগ্ধ, রাখালদার চাপা ভালবাসার প্রথম প্রকাশে দুজনেই মুগ্ধ হলেন।
সবাই বলেছিলেন এম-এ পড়তে, কিন্তু বৃদ্ধ বাবার পেন্সনের টাকায় আর পড়তে রাজী হলো না পরিমল। মতিঝিল কলোনীর একটা স্কুলে শ দেড়েক টাকায় মাস্টারী শুরু করে দিল।
ছাত্র থেকে মাস্টার হলো পরিমল, কিন্তু আর কিছু পরিবর্তন হলো না। এখনও রাত জেগে পড়াশুনা করে, ছাত্র পড়ায়, কলোনীর সব ব্যাপারে পুরো দমে মাথা ঘামায়, বৌদিকে নিয়ে আগের মতোই হৈ হুল্লোড় করে। সবাই খুশি। প্রফুল্লবাবু খুশি, তাঁর স্ত্রী খুশি; পরিমল খুশি, বৌদি খুশি, রাখালদা খুশি। কলোনীর সবাই খুশি। খুশির মধ্য দিয়েই আরো দুটো বছর কেটে গেল।
হঠাৎ একদিন পরিমল একটা নতুন স্যুট নিয়ে বাড়ী আসতেই বাবা-মা একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার রে! চিরকাল ধুতি পাঞ্জাবি পরে কাটাবার পর এখন আবার কোট-প্যান্ট আনলি কেন?
পরিমল বলেছিল, কলেজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দিল্লী বেড়াতে যাচ্ছি। দিল্লীতে তো ভীষণ শীত, তাই কোট-প্যান্ট নিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ যদি ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়ি, সেই আর কি..
বাবা-মা বলেছিলেন, ভালই করেছিস।
মা সঙ্গে সঙ্গে ও-বাড়ী ছুটে গেলেন, জানো দিদি, জানো বৌমা, খোকন দিল্লী যাচ্ছে। ওখানে তো ভীষণ শীত তাই কোট-প্যান্টও কিনে এনেছে।
বৌদি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন এ বাড়ী। ঠাকুরপোর হাতটা ধরে একটা টান দিয়ে বললেন, ডুবে ডুবে জল খাওয়া কবে থেকে শিখলে ঠাকুরপো? তুমি যে দিল্লী যাবে, একথা তো একটিবারও আমাকে জানালে না।
বৌদির একটু অভিমান ভাঙ্গাবার জন্য একটু রসিকতা করে বললো, কি করি বল বৌদি! তোমরা তো বিয়ে-টিয়ে করে বেশ আছ। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আমার তো ওসব কিছু হবে না, তাই মন ভাল করার জন্য একটু কদিনের জন্য ঘুরে আসছি।
এক মুহূর্তে বৌদির সব অভিমান বিদায় নিল। ঠোঁটের চারপাশে হাসির রেখা ফুটে উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আজই তোমার দাদাকে বলছি।
বেশ একটু চেঁচিয়েই পরিমল বললো, দোহাই তোমার, একটু তাড়াতাড়ি কর।
যাবার দিন রাখালদাই দায়িত্ব নিলেন পরিমলকে ট্রেনে তুলে দেবার। পরিমল বারবার বারণ করেছিল, কিন্তু রাখালদা বলেছিলেন, তা হয় না খোকন। তুই দিল্লী যাবি আর আমি স্টেশনে যাব না?
পাঁচটার সময় অফিস ছুটি হবার পরই রাখালদা হাওড়া রওনা হয়েছিলেন। একটু ঘুরে-ফিরে ট্রেন ছাড়বার অনেক আগেই প্ল্যাটফর্মে হাজির হলেন। একবার নয়, দুবার নয়, বহুবার সমস্ত থার্ডক্লাশ কম্পার্টমেন্ট তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু পরিমলের দেখা পেলেন না। কি মনে করে সেকেণ্ড ক্লাশগুলোতে একবার দেখে নিলেন। তবুও পরিমলকে পেলেন না। ট্রেন ছাড়ার তখন মাত্র মিনিট পনেরো বাকি। একবার পুরো ট্রেনটাই ভাল করে খুঁজতে গিয়ে একটা ফার্স্ট ক্লাশ কামরায় পরিমলকে আবিষ্কার করলেন। রাখালদা তো অবাক। জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার রে খোকন? একবারে ফার্স্ট ক্লাশে করে দিল্লী চলেছিস!
পরিমল বলেছিল, কি আর করব? কোন ক্লাশে টিকিট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ফার্স্ট ক্লাশের টিকিট কেটেছি।
তা তোর আর সব বন্ধু-বান্ধব কই?
পরিমল ঘাবড়ে যায়। একটু সামলে নিয়ে বলে, ওরা সবাই কাল রওনা হবে। আমি একদিন আগে গিয়ে সব ব্যবস্থা করব কিনা তাই……
কয়েক মিনিট বাদেই দিল্লী মেল ছেড়ে দিল।
রাখালদা কি যেন মনে করে রিজার্ভেশন চার্ট দেখলেন। না তো অন্য কারুর পাশ নিয়ে তো যায়নি, নিজের নামেই তো রিজার্ভেশন। তবে নামের পাশে তো টিকিটের নম্বর নয়, ওটা তো একটা সরকারী পাশের নম্বর। রাখালদা একটু আশ্চর্য হন, একবার যেন চমকে ওঠেন। ফার্স্ট ক্লাশ পাশ! সে তো অনেক বড় বড় অফিসার পায়। তবে কি অন্য কিছু? রাখালদার মনে বেশ একটা আলোড়ন হয়।