বেশ ভাল ভাবেই রাখালদার বিয়ে হলো। প্রফুল্লবাবু বরকর্তা হয়ে গিয়েছিলেন আর পরিমলের পরই সব দায়িত্ব ছিল। বৌভাতের দিন শ দেড়েক লোক নিমন্ত্রিত হয়েছিল। তাঁদের আদর-অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে লাউড স্পীকারে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাবার ব্যবস্থা–সব কিছুই পরিমল করেছিল।
বীথিকা বৌদিকে বিয়ে করে রাখালদা বেশ সুখী হলেন। জীবনে যারা আকাশকুসুম কল্পনা করে না, যাদের চাওয়া ও পাওয়া দুটোই সীমাবদ্ধ, মনের মতন স্ত্রী পাওয়াই তাদের সব চাইতে বড় কাম্য। রাখালদা বিএ পাস করে ফেয়ারলি প্লেসে রেলের বুকিং অফিসে মোটামুটি ভালই চাকরি করতেন। মাইনে হয়তো খুব বেশী পেতেন না, কিন্তু পাকা সরকারী চাকরিতে অনেক শান্তি অনেক নির্ভরতা। তবে খাটুনি ছিল বেশ। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তেন আর বাড়ী ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা-সাড়ে আটটা বাজত। বেশীদিন সরকারী বা সওদাগরী অফিসে চাকরি করলে ছুটির দিন তাসখেলা ছাড়া বড় একটা সখ-আনন্দ কারুর থাকে না। রাখালদার সে সখও ছিল না। তবে হ্যাঁ, রবিবার দুপুরে একটু দিবানিদ্রা ও পরে ইভিনিং শোতে একটা সিনেমা দেখা তাঁর অনেকদিনের অভ্যাস।
বীথিকা বৌদির জীবনটাও একটা ছকের মধ্যে বাঁধা পড়ল। ভোরবেলায় উঠে রান্না-বান্না করে স্বামীকে অফিস পাঠানোই ছিল প্রথম ও প্রধান কাজ। রাখালদা অফিসে চলে গেলে শ্বশুর-শাশুড়ী ও নিজের রান্না করতেন। সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা রান্নাঘর নিয়ে পড়ে থাকতে তার মন চাইত না। তাইতো শ্বশুর-শাশুড়ীর খাওয়া-দাওয়া হতে না হতেই রাত্রের রান্না শুরু করে দিতেন। নিজের খাওয়া-দাওয়া মিটতে মিটতে একটু বেলা হতো তবে ওবেলার কোন তাড়া থাকত না, এই যা শান্তি।
বেলা একটু পড়তে না পড়তেই রাখালদার মা উঠে পড়তেন। ইতিমধ্যেই একটু বিশ্রাম করে বীথিকা বৌদি যেতেন পরিমলের মা, মাসিমার কাছে। একটু গল্প-গুজব করতে না করতেই পরিমল ঠাকুরপো কলেজ থেকে ফিরত। তারপর বৌদির সঙ্গে শুরু হতো কলেজের গল্প। কলকাতার কলেজে প্রতিদিন কত মজার ঘটনাই ঘটে। বৌদি কলেজে যেতেন না, কিন্তু ঠাকুরপোর কাছে গল্প শুনে সে সব মজা উপভোগ করতেন। শুধু গল্প শোনানো নয়, পরিমল ঠাকুরপোর আরো অনেক কাজ ছিল। বই পড়া ছিল বৌদির নেশা। দেশহিতৈষী পাঠাগারে যেসব বই আছে, সেসব অনেকদিন আগেই পড়া। কলেজ লাইব্রেরী থেকে নিত্য বই আনা ছিল পরিমল ঠাকুরপোর অন্যতম প্রধান কাজ। সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকাও নিত্য আসত। বৌদির ভীষণ ভাল লাগত। বিয়ের আগে রাণাঘাট শহরের যেখানেই কোন গানের জলসা হোক না কেন, বৌদি শুনতেন। বিয়ের পর এসব সখ-আনন্দের কথা প্রথম বলেছিলেন পরিমল ঠাকুরপোকে, আচ্ছা ঠাকুরপো, তোমাদের কলেজে বা এদিকে কোন পাড়ায় জলসা হয় না?
সে-কি বৌদি! তুমি কি একটা আশ্চর্য প্রশ্ন করলে বল তো? কলকাতার কলেজে শুধু গানের জলসা কেন, বক্তৃতার জলসা, পলিটিক্সের জলসা ও আরো কত রকমের জলসা হয়। হয় না শুধু পদ্য শুনার জলসা।
তাই নাকি ঠাকুরপো?
তবে আবার কি?
ঠাকুরপো একটু চুপ করে আবার শুরু করে, বাল্মিকীর মতো ভাল ইম্যাজিনেটিভ রাইটার বা কালিদাসের মতো ভাল রোমান্টিক কবি থাকলে একালে কলকাতার যে কোন এক একটি কলেজ নিয়ে রামায়ণ বা শকুন্তলার চাইতে আরো মোটা, আরো ভাল বই লিখতে পারতেন।
বৌদি একটু মুচকি হাসেন!
তুমি হাসছ বৌদি। কিন্তু বিশ্বাস কর, কলকাতার কলেজগুলো এক-একটি আজব চিড়িয়াখানা। ছাত্র-অধ্যাপক সবাই রসিক। আদিরস, বাৎসল্য, বীর-রস, ভয়-রস, বীভৎস-রস ও আরো অনেক রসের মশলা একত্রে যদি কোথাও পাওয়া যায়, তবে তা কলকাতার কলেজ।
পরিমল ঠাকুরপোর কাছে গল্প শুনতে বেশ লাগে বৌদির। কলেজের সোস্যালের সময় জলসার দুটো কার্ড জোগাড় করে পরিমল। রাখালদাকে কার্ড দুটো দিয়ে বলে, শুধু চীফ কমার্শিয়াল সুপারিনটেনডেন্টের সেবা না করে একটু বৌদির সেবাও করো।
রাখালদার জলসা-টলসায় কোন আগ্রহ নেই। এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বলেন, তোর বৌদির যত বাতিক। মধ্যমগ্রাম থেকে ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউটে গিয়ে কটা আধুনিক গান শোনার কোন অর্থ হয়।
রাখালদাকে তবুও যেতে হয়। স্ত্রীর আব্দারের চাইতে পরিমলের আগ্রহকে অগ্রাহ্য করা তার কঠিন হয়। বৌদির কিন্তু বেশ লাগে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানান পরিমলকে।
রাখালদা নিতান্তই একজন ভদ্রলোক। কোন সাতে-পাঁচে নেই। কোন অহেতুক বাতিক নেই। কলোনীর সবার সঙ্গেই পরিচয় আছে, কিন্তু একটু অতিরিক্ত খাতির কারুর সঙ্গে নেই। পরিমল ও বৌদি দুজনেই মাঝে মাঝে সুবিধামত টিপ্পনী কাটেন রাখালদার অফিস নিয়ে। পরিমল বলে, রাখালদা, তুমি মোর লয়াল দ্যান দি কিং, রাজার চাইতে বেশী রাজভক্ত।
বৌদি বলেন, না, না, ঠাকুরপো। তোমার দাদা হচ্ছেন সি-সি-এস-এর ঘরজামাই।
রাখালদা এসব সমালোচনা মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যান। শুধু বলেন, যার অফিস ফেয়ারলি প্লেসে সে কি করে আনফেয়ার হবে বলো?
নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে রাখালদার, কিন্তু পরিমল ঠিক তার বিপরীত। প্রতি পদক্ষেপে তার প্রাণশক্তির প্রকাশ। দেশহিতৈষী কলোনীর সব কিছুতেই সে সবার আগে। মাস তিনেকের অক্লান্ত পরিশ্রমে কলোনীর ছেলেদের সাহায্যে একটা চমৎকার পার্ক করেছে এই কলোনীরই একটা পতিত জমিতে। প্রত্যেক রাস্তার নামকরণ করে বোর্ড লাগিয়েছে, কেরোসিনের টিন কেটে রং মাখিয়ে ওয়েষ্ট বিন করে সব রাস্তায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। রবিবারের সাহিত্য-সভা, মেয়েদের জন্য পূর্ণিমা সম্মিলনী, বাচ্চাদের জন্য আগমনী সংসদও পরিমলের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই কলোনীতে। এত কাজ করেও নিজের পড়াশুনায় বিন্দুমাত্র গাফিলতি নেই পরিমলের। এরই মধ্যে এক ফাঁকে মতিঝিল কলোনীতে দুটি ছেলেকে পড়িয়ে আসে।