সভাকবিদের টুকরো-টুকরো কাব্যের মধ্য দিয়ে যেমন অতীতের বহু মানুষের জীবন কাহিনীর একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়, আজকের দিনের রিপোর্টারদের টুকরো-টুকরো রিপোর্টের মধ্য দিয়েও তেমনি বহু মানুষের জীবন-কাহিনীর একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি ফুটে উঠবে। রিপোর্টারদের কলমে বা টাইপরাইটারে আজ যিনি ছাত্রনেতা বা ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম কর্মী, আগামী দিনে তিনিই হয়ত মন্ত্রী। মাঝখানে তাঁর কারাবরণের কথা ও মুক্তিলাভের খবরও ঐ একই টাইপরাইটারে লেখা হয়। শুধু কি তাই? ঐ একই রিপোর্টার হয়ত মন্ত্রীর পদত্যাগ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তার তদন্ত, তদন্তের খবর ফাঁস, সরকার কর্তৃক তদন্তের রিপোর্ট নাকচ, মন্ত্রীর দলত্যাগ, আবার পুরনো দলে ফিরে আসা, মন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ, তাঁর প্রতিদিনের কাজকর্ম, এমন কি তার প্রেম, বিয়ে বা নার্সিংহোমে পুত্রসন্তান জন্মের খবরও ঐ রিপোর্টারের কলমেই লেখা হয়। অদৃষ্টের পরিহাসে ঐ মন্ত্রীর মৃত্যু সংবাদও হয়তো একই রিপোর্টারের টাইপরাইটারে লেখা হবে। দীর্ঘদিনের বিস্তীর্ণ পরিবেশে লেখা এইসব টুকরো-টুকরো খবর জুড়লে নিশ্চয়ই একটা জীবন-কাহিনীর পূণ রূপ দেখা যাবে। রিপোর্টারের দল সবার অলক্ষে হয়তো নিজেদেরও অজ্ঞাতসারে অসংখ্য মানুষের জীবন-কাহিনী লিখে যান। অতীতের সভাকবিদের মতো আজকের দিনের খবরের কাগজের রিপোর্টাররাও লেখেন না শুধু নিজেদের কথা, নিজেদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-বেদনার ইতিহাস।
তাইতো নির্মলদার ইতিহাস হয়তো কেউ জানবেন না, কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবেন না, কেউ তাঁর জীবনের আনন্দ বেদনার উষ্ণতা অনুভব করবেন না নিজেদের অন্তরে। নির্মলদার জীবন-নাট্যে আমি অভিনয় করিনি, ড্রপ সিন টানিনি, উইং স্ক্রীনের পাশ থেকে প্রম্পটারের কাজ করিনি, গ্রীনরুমেও যাইনি। তবে অদৃষ্টের পরিহাসে দুটি প্রাণীর জীবন-নাট্যের চরম কয়েকটি দৃশ্যের একমাত্র দর্শকরূপে আমি তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
নির্মলদা ও নির্মলাবৌদি দীর্ঘ ও বিচিত্র জীবনপথ পাড়ি দিয়ে ছিলেন। এক পান্থশালা থেকে আরেক পান্থশালায় গিয়েছেন ওঁরা দুজনে। আমি তাদের সহযাত্রী হবার গৌরব অর্জন করিনি, কিন্তু ওঁদের জীবনপথের প্রান্তসীমায় এক পান্থশালায় মাত্র কয়েকটি স্মরণীয় রাত্রির জন্য আমি সঙ্গী হয়েছিলাম। ধন্য হয়েছিলাম ঐ দুটি মহাপ্রাণের কাছে এসে। ওঁদের দুজনের ভালবাসার আত্মতৃপ্তিতে আমি আমার অন্তর ভরিয়েছিলাম। অতর্কিত আক্রমণ করে ঐ দুটি প্রাণীর স্নেহ ভালবাসা দশ হাতে লুটপাট করে নিয়েছি, কিন্তু তার বিনিময়ে শুধু কফোঁটা চোখের জল ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি আমি।
নির্মলাবৌদি তাঁর হৃদয়-ঔদার্যে আমার হৃদয়-কার্পণ্য ক্ষমা করলেও আমি নিজে বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত একটা অসহ্য জ্বালা অনুভব করি। কাজকর্মের অবসরে নিজের অজ্ঞাতে আজও দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে আমার বুকটাকে ভারী করে তোলে, মনটাকে পীড়িত করে। মানুষকে আমি ভালবাসি। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে আমি ধন্য হয়েছি, কিন্তু কেন জানি না মানুষের যত কাছে এসেছি, ততই তাদের সুখ-দুঃখের ঝঙ্কার এমন তীব্রভাবে আমার অন্তরে বেজেছে যে, বেদনা অনুভব করেছি।
গত বছরের মত এবারও লণ্ডন এয়ারপোর্টে শুধু একটি প্রাণীই আমাকে রিসিভ করতে এসেছিলেন। বন্ধুবান্ধব বা বান্ধবীদের আমার যাবার কথা জানাই, কিন্তু ঠিক কবে কোন্ ফ্লাইটে কটার সময় কোথা থেকে লণ্ডন পৌঁছাচ্ছি, সে কথা জানাই না। লণ্ডনের মাটিতে পা দিয়ে প্রথমে আমি শুধু একটি প্রাণীকেই দেখতে চাই, তাঁকে প্রণাম করতে চাই, তার বুকে আত্মসমর্পণ করতে চাই। লণ্ডনে পৌঁছে প্রমথ কয়েকটি আনন্দ বেদনাতুর মুহূর্তে আমাদের দুজনের মাঝখানে হাইফেনের মতো অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে আমি কল্পনা করতে পারি না। তাইতো এবারেও সবাইকে জানিয়েছিলাম কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে লণ্ডন আসছি। কিন্তু দাস ফার, নো ফারদার। শুধু নির্মলাবৌদিকে লিখেছিলাম—
বৌদি,
আমি আসছি। ১১ই জুন সুইস এয়ার ফ্লাইটে জুরিখ থেকে বিকেল চারটে কুড়িতে লণ্ডন পৌঁছাব। কদিন আবার দুজনে কাঁদব, গাইব, বেড়াব। কেমন? প্রণাম নিও।
তোমার ঠাকুরপো।
চিঠি পাবার পরই নির্মলাবৌদি আমার জন্য ঘর দোর ঠিক করতে লেগে পড়েছিলেন। আমি ঠিক যা যা চাই, যা কিছু ভালবাসি, তার আয়োজন সম্পূর্ণ করেছিলেন আমি আসার কদিন আগেই। এগারোই জুন বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনটে বাজতে না বাজতেই নির্মলাবৌদি এয়ারপোর্টে হাজির হয়েছিলেন। আমি কাস্টমস এনক্লোজারে ঢুকতেই দেখলাম বেরুবার রাস্তায় দেওয়ালে মাথাটা ভর দিয়ে একটু কাত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার নির্মলাবৌদি। আমি হাত তুলে ইশারা করলে উনি একটু হেসে হাত তুলে প্রত্যুত্তর দিলেন আমাকে। তারপর কয়েক মিনিট পরে কাস্টমস চেক্ শেষ করে বেরিয়ে আসতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলাম নির্মলাবৌদিকে। বৌদিও দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। দু এক মিনিট পরে কফোঁটা চোখের জল আমার গালে গড়িয়ে পড়তে খেয়াল হলো বৌদি নিশ্চয়ই কাঁদছেন। হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নিয়ে বৌদির চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললাম, ছিঃ বৌদি, তুমি কাঁদছ? এত দূর থেকে ছুটে এলাম তোমার কাছে সে কি তোমার চোখের জল দেখবার জন্য?