নটটা বাঁধা হয়ে গেলে টাইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ডাক্তার বললো, আমি কিন্তু তোমাকে কোনদিন ভুলব না।
ডাক্তার আমার বিদায় বেলার একটি মুহূর্তও নষ্ট করেনি। বলেছিল, বাচ্চু, তুমি এবার একটা বিয়ে কর। আর দেরী কোরো না। তাছাড়া তোমাকে যেন একলা ভাল লাগে না। তোমাকে একলা ভাবতেও ভাল লাগে না।
হাসপাতালে ডাক্তারের ডিউটি ছিল। অনেক দেরী হয়েছিল, আর দেরী করল না। টেবিলের পর থেকে প্রেজেনটেশনের প্যাকেটগুলো এনে আমার হাতে দিল, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। দুজনে মুখোমুখি নীরবে চোখের জল ফেলেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ।
তারপর ধীর পদক্ষেপে ডাক্তার চলে গেল আর আমি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেললাম।
৫. বিধাতা পুরুষের ঔদার্য অনেক
বিধাতা পুরুষের ঔদার্য অনেক, কিন্তু কৃপণতাও কম নয়। এই দুনিয়ার সর্বত্র তাঁর বদান্যতার প্রকাশ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে কৃপণ মনোবৃত্তির অসংখ্য পরিচয়। এই পৃথিবীর একদিকে যখন আলো, অন্যদিকে তখনই অন্ধকারের রাজত্ব চলে। অনন্তকাল ধরে এই সনাতন নিয়ম পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে চলেছে। পৃথিবীর দুটি দিক একই সঙ্গে সূর্যের আলোয় ভরে উঠবে না, অন্ধকারের মধ্যেও-ডুব দেবে না।
এই পৃথিবীর বুকে যে মানুষের বাস তার জীবনেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নেই! অজস্র কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ভগবান একটি পরিপূর্ণ সুখী মানুষ তৈরী করতে পারেননি। জীবনের একদিকে যার আলোয় ভরে গেছে, সাফল্যে ঝলমল করে উঠেছে, তারই জীবনের অপর দিকে নিশ্চয়ই অন্ধকারের রাজত্ব। সমাজ সংসার যার মুখের হাসির খবর রাখে, যার সাফল্যের ইতিহাস জানে, তার মনের কান্না, ব্যক্তিগত জীবনের চরম ব্যর্থতার কাহিনী সবাই না জানলেও তা সত্য। এই দুনিয়ায় কেউ প্রকাশ্যে, কেউ লুকিয়ে কাঁদে, কিন্তু কাঁদে সবাই। অত বড় সার্থক, সাফল্যমণ্ডিত ডিপ্লোম্যাট মিঃ পরিমল বোসও কাঁদতেন। তবে তার চোখের জলের কাহিনী, ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতার ইতিহাস কেউ জানে না, জানবেও না।
ভারতবর্ষের ফরেন সার্ভিসের সবাই পরিমল বোসকে চেনেন। তাঁর সুখ্যাতির কাহিনী ভারতের প্রায় সমস্ত দূতাবাসে শোনা যাবে, শোনা যাবে দিল্লীর সাউথ ব্লকে ফরেন মিনিষ্ট্ৰীতে। লণ্ডনে ইণ্ডিয়ান হাই কমিশনে আসার আগে মিঃ বোস ওয়াশিংটন, কায়রো, মস্কো ও ইউনাইটেড নেশনস-এ কাজ করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন। অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং সর্বত্রই ভারতের পররাষ্ট্র নীতি প্রচারে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এই তো সেবার লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে শেষের দিন মূল ইস্তাহার নিয়ে ভীষণ মতভেদ দেখা দিল কয়েকটি দেশের মধ্যে। মার্লবোরা হাউসের কনফারেন্স চেম্বারে ঝড় বয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মিঃ বোসের ড্রাফট্ মেনে নিলেন সবাই।
পরে ক্ল্যারিজেস হোটেলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মিঃ বোসের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। দিল্লী ফিরে বিজ্ঞান ভবনে এক বিরাট সাংবাদিক সম্মেলনেও মিঃ বোসের কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রশংসা করতে তিনি দ্বিধা করেননি।
কর্মজীবনে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছেন মিঃ বোস। সার্থক, সাফল্যমণ্ডিত ডিপ্লোম্যাট মিঃ পরিমল বোসের খবর সবাই জানেন, জানেন না তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিচিত্র ও বেদনাভরা ইতিহাস…
…রিটায়ার করার ঠিক আগের বছর সোনার বাংলা দুটুকরো হলো। দেশ স্বাধীন হলো। প্রফুল্লবাবু সপরিবারে চলে এলেন কলকাতায়। সরকারী চাকরী থেকে রিটায়ার করার পরই প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকায় মধ্যমগ্রাম দেশহিতৈষী কলোনীতে কয়েক কাঠা জমি কিনলেন, ছোট একটা মাথা গোঁজার আস্তানা তৈরী করলেন। একদিন মধ্যমগ্রামের যে জমি পতিত ছিল, যে জলাকীর্ণ বিস্তীর্ণ অঞ্চল মানুষের অগম্য ছিল, বছর কয়েকের মধ্যে সেইখানেই নবাগত কয়েক শ পরিবারের কলগুঞ্জনে মুখর হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে নানা ধরনের ঘর বাড়ী উঠে পড়ল, ছন্নছাড়া কিছু মানুষ আবার স্বপ্ন দেখল ভবিষ্যতের। প্রথম বছর সম্ভব হয়নি, কিন্তু পরের বছরই দুর্গাপূজা শুরু হলো। কলোনীর একদল ছেলে-মেয়ে মিলে নববর্ষ রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব চালু করল। কিছুদিনের মধ্যে দেশহিতৈষী পাঠাগারও গড়ে উঠল। প্রাণচঞ্চল নতুন কলোনীতে আরো অনেক কিছু হলো। মানুষে-মানুষে পরিবারে-পরিবারে হৃদ্যতার গাঁটছড়াও বাঁধা পড়ল।
বোসদের বাড়ীর পরেই একটা পুকুর। তার ওপাশে রাখালদাদের বাড়ী। এই কলোনীতে আসার পরই রাখালদার ছোট দুটি বোনের বিয়ে হলো। কলোনীর প্রায় সবাই এসে সাহায্য করেছিলেন বিয়েতে, কিন্তু পরিমলের মতো কেউ নয়। জামাইরা তো প্রথম প্রথম বুঝতেই পারেনি পরিমল ওদের আপন শালা নয়।
পরিমল যখন থার্ড ইয়ারে পড়ে তখন রাখালদার বিয়ে হয়েছিল। রাখালদার বাবার সঙ্গে পরিমলই প্রথম রাণাঘাট গিয়ে তার বীথিকা বৌদিকে দেখে এসেছিল। রংটা একটু চাপা হলেও দেখতে শুনতে বীথিকা বৌদিকে ভালই লেগেছিল। ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেই পড়াশুনা ছাড়লেও পড়াশুনার চর্চা ছিল। গানবাজনা না জানলেও সখ ছিল। স্কুলে পড়ার সময় মাঝে মাঝে থিয়েটারও করেছেন।