আজ সেই দুটি অবিস্মরণীয় দিনের কথা রোমন্থন করতে গিয়ে টুকরো টুকরো আরো অনেক কিছু মনে পড়ছে। ঘোরাঘুরি করে আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়েছিলাম। ফিরে এসেই ঝপাং করে ডাক্তারের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ডাক্তার চেঞ্জ করতে বাথরুম থেকে বেরুবার আগেই আমি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তার আলতো করে আমার জুতা-মোজা-টাই খুলেছিল, আমাকে পাশ ফিরিয়ে ভাল করে শুইয়ে দিয়েছিল। দুএক ঘণ্টা পরে আমাকে জোর করে তুলে ডিনার খাইয়েছিল। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই শোনেনি। বলেছিল, এত ঘোরাঘুরির পর রাত্রে না খেলে শরীর ভীষণ দুর্বল হবে।
পরের দিন আমাকে নিজে পছন্দ করে টাই পরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দেখ কি চমৎকার দেখাচ্ছে। একটু দুষ্টুমি করে আমার মুখটা ধরে বলেছিল, নাউ রিয়েলি ইউ ল্যুক লাইক এ হ্যাণ্ডসাম ইয়ংম্যান।
তাই বুঝি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। পিরামিডের চূড়া রাঙ্গিয়ে সূর্য অস্ত গেল। ডাক্তার আবার উদাস হলো।
ব্যালকনিতে দুটো পিপিং চেয়ারে দুজনে বসেছিলাম। ডাক্তার আমার হাতটা নিয়ে খেলা করছিল। খেলা থেমে গেল, হঠাৎ কোথায় তলিয়ে গেল। একটু পরে দেশের কথা আবার শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে আমার হাতটাকে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ–শরৎচন্দ্র কি শুধু হিন্দুদের, নজরুল বা জসীমউদ্দীন কি শুধু আমাদের? বাংলার পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, কবি গান কি শুধু হিন্দুদের, না মুসলমানদের? আমরা লড়াই করেছি, ঝগড়া করেছি, মারামারি করেছি, কিন্তু তাই বলে কি বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের দেহে একই রক্ত বইছে না? বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের জন্য পলাশীর মাঠে হিন্দু-মুসলমানের কি মিলিত রক্তপাত হয়নি?
ডাক্তার আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, বাচ্চু, তুমি তো জার্নালিস্ট। বল না, কেন এমন হলো? কেন আজ বাঙ্গালী বাংলা দেশে চোখের জল ফেলছে?
আমরা দুজনে একই ফ্লাইটে কায়রো থেকে করাচী এলাম। দুজনের মনটাই ভারী হয়েছিল, বিশেষ কেউই কথাবার্তা বলিনি। শুধু একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি করাচীতে কোথায় থাকবে?
হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে।
শেষ রাতের দিকে পায়ের পর থেকে কম্বলটাকে দুজনেরই গলা পর্যন্ত টেনে দিয়েছিল। আর? আর একটু নিবিড় হয়ে আমার বুকের পর মাথা রেখেছিল।
ভোর বেলায় প্লেন করাচী পৌঁছল। পাকিস্তানের মাটিতে পা দিতে দিতেই ডাক্তার এমন করে আমাকে আঘাত দেবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। যতবার কাছে গেছি, ততবার সরে গেছে। যতবার কথা বলেছি, ততবার ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কাস্টমস এনক্লোজারের বাইরে বেরুবার আগে ডাক্তার আমাকে এমন তাচ্ছিল্যভাবে অগ্রাহ্য করল যে আমি মর্মাহত না হয়ে পারলাম না। কোন প্লেন থাকলে হয়তো সিটিতে না ঢুকে দিল্লীই ফিরে আসতাম।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত কতকগুলো খবরের কাগজ কিনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল রওনা হলাম। খবরের কাগজগুলো খুলে চমকে উঠলাম। বুঝলাম ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহাকাশে ঘোর ঘনঘটা দেখা দিয়েছে, ভারতকে শায়েস্তা করার নেশায় পাকিস্তান উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
পরের দিন রাত আড়াইটের সময় আবার প্লেন। তাই কাজ কর্ম সন্ধ্যার মধ্যেই সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেব। হোটেলে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ডাইনিং রুমে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি ঠিক এমনি সময় কে যেন দরজায় নক করল। দরজা খুলতেই ডাক্তারকে দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হাসিমুখে ডাক্তারকে অভ্যর্থনা করতে পারলাম না, গম্ভীর হয়েই বললাম, এসো।
ডাক্তার হাতের প্যাকেটগুলো টেবিলের উপর রেখে সামনে এসে অসহায়ার মতো আমার দিকে চাইল। দুহাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে বললো, তুমি খুব রাগ করেছ, তাই না বাচ্চু?
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
ডাক্তার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে বললো, কি করব বলল। এয়ারপোর্টে বেশী কথাবার্তা বললে হয়তো তুমি কিছু মুস্কিলে পড়তে, নয়ত আমার কোন ঝঞ্ঝাট বাধত। তাইতো…
এতক্ষণে হুঁস হলো ডাক্তারকে বসতেও বলিনি। বললাম, বোসো।
ডাক্তার সোফায় না বসে বিছানায় বসল। আমার হাত ধরে পাশে বসাল। আমার দিকে একবার চাইল। দুচার মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল ডাক্তার।
বলো না, তুমি আমার পর রাগ করনি, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।
আমি শুধু বললাম, কোন্ অধিকারে তোমার পর রাগ করব বলো? বাঙ্গালী বলে বিদেশ বিভূঁইতে তুমি আমাকে যে ভালবাসা, যে মর্যাদা দিয়েছ, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এর চাইতে বেশী কিছু প্রত্যাশা করা তো আমার অন্যায়।
এবার ডাক্তারের দিকে ফিরে বললাম, আর ক্ষমা? তুমি হাসালে ডাক্তার। আমার কাছে তুমি ক্ষমা চাইবে কেন?
ডাক্তারের চোখের জলের কাছে শেষ পর্যন্ত আমাকে হার মানতে হলো। বললাম, হ্যাঁ, রাগ করেছিলাম, দুঃখ হয়েছিল কিন্তু এখন আর কিছু নেই।
আমার ডান হাতটা টেনে নিজের বুকের পর রেখে ডাক্তার বললো, আমাকে ছুঁয়ে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।
আমি আর কথা বলিনি। দুহাত দিয়ে ডাক্তারকে টেনে নিয়েছিলাম নিজের বুকের মধ্যে।
একটু পরে আমার গলা থেকে টাইটা খুলে একটা নতুন টাই বেঁধে দিল। টাই-এর নটটা ঠিক করতে করতে বললো, তুমি তো জার্নালিস্ট। কত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তোমার নিত্য ওঠা বসা। তোমার পক্ষে আমার মতন একটা সাধারণ বাঙ্গালী মেয়েকে নিশ্চয়ই মনে রাখা সম্ভব নয়।