ডাক্তারের চোখ মুখ দেখে মনে হলো সে যেন আমার কথায় অনেকটা স্বস্তি ও শান্তি পেয়েছে।
কথায় কথায় বলা হয়েছিল। আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবার চলি। আপনি লাঞ্চ খেয়ে একটু বিশ্রাম করুন।
কেন একসঙ্গে লাঞ্চ খেলে জাত যাবে?
ছি, ছি, আপনি কি বলছেন?
ডাক্তারের ঘরে বসেই সেদিন দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিলাম। পরমাত্মীয়ার মতো যত্ন করে আমাকে সে খাইয়েছিল। ওজর আপত্তি অগ্রাহ্য করে সে প্রায় সব মাংসটাই আমার প্লেটে ঢেলে দিয়েছিল।
নাইল নদীর জল আরো গড়িয়েছিল। সোফা ছেড়ে ডাক্তারের বিছানায় বালিশটা পিঠে দিয়ে একটু কাৎ হয়ে বসেছিলাম। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করল, তুমি একটু শোবে?
না, না, শোব না।
কেন লজ্জা করছে? নাকি দুর্নামের ভয়?
ডাক্তার আমার মুখের দিকে চেয়েছিল, কিন্তু উত্তর সে নিজেই দিয়েছিল।
ভয় নেই বাচ্চু, এটা বাংলা দেশ নয় যে দুর্নাম রটবে। তুমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শুতে পারো।
ডাঃ মৈমুনা সুলতানার আরো অনেক স্মৃতি আজও আমার মনের মধ্যে রজনীগন্ধার মতো মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। আবার একটু পরেই ঝরা বকুলের মত বেদনা বোধ করি মনে মনে। খবরের কাগজের রিপোর্টার হয়েও ঐ দুটি দিনের রিপোর্ট লেখার ক্ষমতা আমার নেই। মানুষের মুখের কথার আমি রিপোর্ট লিখি, কিন্তু মনের কথা লেখবার বিদ্যা তো আমার জানা নেই। তবে মনে পড়ে…
ডাক্তার হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে গেল। দৃষ্টিটা নাইল হোটেলের জানলা থেকে নাইল নদী পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেল, চলে গেল পদ্মা-মেঘনা-বুড়ীগঙ্গা-কর্ণফুলির দেশে।
জানো বাচ্চু, কে আমাকে প্রথম এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন?
আমি চুপ করেই রইলাম।
জগন্নাথ কাকা। শুনেছি মার পেটে থেকে বেরুবার পর আমি কোন কান্নাকাটি না করায় বাড়ির সবাই ভাবলেন আমি বেঁচে নেই। জগন্নাথ কাকা কোন কথা না বলে এক কড়া গরম জল চেয়ে নিলেন। তারপর আমার পা দুটো ধরে গরম জলের মধ্যে ডুবিয়ে তুলে এনে পিঠে পটাপট চড় মারতে লাগলেন। আধ ঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট এই রকম জলের তাপ আর জগন্নাথ কাকার চড় খেয়ে আমি হঠাৎ কেঁদে উঠলাম। বাবা ছুটে এসে জগন্নাথ কাকাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, জগন্নাথ! গত জন্মে তুই নিশ্চয়ই আমার ভাই ছিলি, নয়তো মেয়েটা তোরই মেয়ে ছিল। জগন্নাথ কাকা কোনদিন আমাদের বাড়িতে এসে ভিজিট নিতেন না; তাইতো বাবা নিজের হাতের সোনার ঘড়িটা খুলে তার হাতে পরিয়েছিলেন।
জগন্নাথ ডাক্তার নিজের মেয়ের চাইতে মৈমুনাকে কম ভাল বাসতেন না। হাটের দিন ডিসপেন্সারী থেকে ফেরার পথে মৈমুনার জন্যও এক প্যাকেট মিষ্টি আসত। একটু বড় হলে দুরন্তপনা বা দুষ্টুমি করার জন্য মা মারধর করতে এলেই মৈমুনা ছুটে পালাত জগন্নাথ কাকার বাড়িতে। পূজার সময় মৈমুনাও নতুন জামা পেত তার জগন্নাথ কাকার কাছ থেকে।
নাইলের পাড়ে বসে ডাক্তারের মনে অতীত স্মৃতি যেন ভীড় করে এসেছিল। তার মনে পড়ল মালতী নগরের বড় বাড়ির দুর্গাপূজার কথা, কালীদাদুর সুর করে মন্ত্ৰপড়ার কথা। মনে পড়েছিল, পূজার কদিন আগেই হারানে তার দলবল নিয়ে আসত ঢাক বাজাতে। হারানের ঢাকের আওয়াজ শুনলেই ওরা সবাই ছুটে আসত বড় বাড়িতে। হারানে বড় বাড়িতে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই এক চোট নেচে বাজিয়ে দেখাত। তারপর হারানে দিদার দেওয়া জলপানি খেতে বসলে ঢাক তুলে নিতো কনকদা। আহা সে কি বাজনা! আরতির সময় হারানে আর কনকদার ঢাক বাজানো শুনতে ডাক্তার পূজার প্রতি সন্ধ্যায় ছুটে এসেছে বড় বাড়িতে। অমন বাজনা নাকি ডাক্তার আর কোথাও শোনেনি।
আর কি মনে পড়ে?
মনে পড়ে বুড়ো শিবতলার মেলার কথা, মনে পড়ে রথের কথা। সেদিন কে হিন্দু, কে মুসলমান সে খবর কেউ রাখত না বা রাখার প্রয়োজন বোধ করত না। গ্রামের সবাই মেতে উঠত একই আনন্দে। কেন মহরমের দিন? জগন্নাথ কাকা, যতীন পাকড়াশী, গদাই চক্রবর্তী, হালদার মাষ্টার সবাই আসত ডাক্তারদের বাড়ি। ধর্মের গোঁড়ামি ছিল, সংস্কার ছিল, কিন্তু মানুষকে ভালবাসায় কোন দ্বিধা ছিল না।
এইত প্রথম দাঙ্গা বাধলে জগন্নাথ ডাক্তার উড়ো চিঠি পেল। মৈমুনার বাবা ছুটে গিয়েছিলেন মুন্সীপাড়ার দলবল নিয়ে। বলে ছিলেন, জগন্নাথ, ভয় করিস না। জেনে রাখিস আমি না শেষ হলে তোর এক ফোঁটা রক্ত পড়বে না তোর এই বাপ-ঠাকুরদার ভিটেয়। ঠিক তাই-ই হয়েছিল। গজখালির মুসলমানরা জগন্নাথ ডাক্তারের বাড়ি আক্রমণ করলে রক্তপাত হয়েছিল মৈমুনার বাবার, জগন্নাথ ডাক্তারের নয়।
ডাক্তার আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, জানো বাচ্চু, সেই জগন্নাথ কাকাও একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন, মালতি নগরের বড় বাড়ির পূজা বন্ধ হলো, কনকদার আর হারানের হাতে আর ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় না, বুড়ো শিবতলা জঙ্গলে ভরে গেল, রথের মেলাও বন্ধ হলো।
অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তার চোখের জল আটকাতে পারল না। উত্তেজনায় ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। বললো, বলতে পার বাচ্চু, জগন্নাথ কাকাকে হারিয়ে আমি সুখী, না তোমার শিয়ালদ’ প্ল্যাটফর্মে ভিখারীর মতো পড়ে থেকে সুখী? তুমি তো জার্নালিস্ট, বলতে পার বাংলা দেশটা কেন এমন ছারখার হয়ে গেল?
ডাক্তারের কোন প্রশ্নের জবাব আমি দিইনি, দেবার ক্ষমতাও আমার ছিল না। শুধু ডাক্তারকে কাছে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিলাম।