কপাল থেকে উড়ন্ত চুলগুলো সরিয়ে, পড়ন্ত সিল্কের শাড়ির আঁচলটা টেনে নিতে নিতে ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, আপনি কি কোন জরুরী কাজে বেরুচ্ছেন?
বালাই ষাট এখানেও জরুরী কাজ! ভাবছিলাম খান খালিল বাজারে একটু ঘোরাঘুরি করব।
ডাক্তার লিফট-এর দিকে পা বাড়িয়ে বললো, বাজারে পরে যাওয়া যাবে। এখন চলুন ঘরে গিয়ে একটু আড্ডা দেওয়া যাক।
ডাক্তারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি লিফটে চড়লাম, চার তলায় লিফট থেকে বেরিয়ে এলাম এবং তারপর ডানদিকে ঘুরে কোণার ঘরে গেলাম। ঘরে না বসে আমি এগিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আর এক নজর ঐতিহাসিক নাইলকে দেখলাম। আমি বললাম, আমার ঘরের ব্যালকনির চাইতে আপনার এই ব্যালকনি থেকে নাইলকে আরো অনেক ভালভাবে দেখা যায়।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
কয়েক মিনিট পরে ডাক্তারের আহ্বানে আমি ঘরের ভিতর এসে কোটটা খুলে ফেললাম বিছানার ’পর। বসে পড়লাম সোফায়। ডাক্তার আমার কোটটাকে হ্যাঙ্গারে চড়িয়ে ওয়াড্রবে রাখতে গিয়ে বললো, কোটটাকে তুলে রাখছি, বুঝলেন?
আমি একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললাম, এমনি করে একে একে আমার আরো দায়িত্বগুলো স্বেচ্ছায় তুলে নেবেন নাকি?
ওয়াড্রবে কোটটা ঝোলাতে ঝোলাতে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললো, বিদেশ বিভূঁইতে একটা বাঙ্গালী মেয়েকে একলা পেয়ে ভয় দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো?
আমি বললাম, তাই বুঝি?
ওয়াড্রব বন্ধ করে ডাক্তার আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো, এবার বলুন কি খাবেন?
আমি নির্বিকার হয়ে উত্তর দিলাম, তেলে ভাজা আর মুড়ি।
ডাক্তার না হেসে পারল না। বললো, আপনি তো আচ্ছা লোক।
কেন বলুন তো? ন্যাকামি করে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
কেন আবার? এখানে মুড়ি তেলে ভাজা পাব কোথায়?
বাঙ্গালী বলে স্বেচ্ছায় আলাপ করলেন, আদর করে নিজের ঘরে ডেকে আনলেন, তাই ভাবছিলাম হয়তো বাঙ্গালীর খাবারই খাওয়াবেন।
ডাক্তার আর কথা না বাড়িয়ে চাপা হাসি হাসতে হাসতে টেলিফোনে কফির অর্ডার দিল। কফি এলো। ডাক্তার আমার সামনের সোফায় বসে কফি তৈরি করে আমাকে দিল।
সেদিন ঐ কফির পেয়ালা সামনে নিয়ে আমাদের যে আলোচনা হয়েছিল, তার সুর আজও আমার কানে বাজে। কফির কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি বাংলাদেশে মানুষ হয়েছেন।
না।
তবে তো আপনি খাঁটি বাঙ্গালীই নন।
তাই বুঝি?
ঘাড় বেঁকিয়ে ডাক্তার বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মিনিট দুই চুপচাপ থেকে শেষ চুমুক কফি খেয়ে ডাক্তার বললো, যে বাঙ্গালী কর্ণফুলি-বুড়িগঙ্গা দেখেনি, যে মেঘনায় নৌকো চড়েনি, যে গোয়ালন্দ ঘাটে ইলিশ মাছ খায়নি, যে নবদ্বীপ আর শান্তিনিকেতন দেখেনি, সে আর যাই হোক খাঁটি বাঙ্গালী নয়।
ঢোখটা উপরে উঠিয়ে ঘাড়টা আবার বাঁকা করে ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, বুঝলেন জার্নালিস্ট।
মাদ্রাজীদের মতো এমনভাবে আমি ঘাড় নাড়ালাম যে হ্যাঁ না– দুই-ই হতে পারে।
আলোচনা আরো একটু এগিয়ে চললো। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলো, দিল্লীতে আপনারা কে কে থাকেন?
আমি জানালাম, আমি থাকি, রামচন্দ্র নামে একটা চোর চাকর থাকে; আর আছে দুটো বেড়াল, একটা কুকুর।
কেন আপনি বিয়ে করেন নি?
ছোটবেলা থেকেই তো একটা ফুটফুটে সুন্দর বৌ ঘরে আনার স্বপ্ন দেখে আসছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত তো জুটলো না।
ডাক্তার উড়িয়েই দিলো আমার কথাটা। বললো, তাহলে নিশ্চয়ই কাউকে পছন্দ করে রেখেছেন।
পছন্দ তো অনেককেই হয়েছে, কিন্তু তাদের পাচ্ছি কোথায় বলুন?
ডাক্তার নাছোড়বান্দা। আমার রোগটা ধরবার নেশায় মশগুল হয়ে উঠলো। জিজ্ঞাসা করলো, বলুন না কাকে পছন্দ করে পাচ্ছেন না?
পছন্দ তো এলিজাবেথ টেলর–আঁদ্রে হেপবার্নকেও করেছি। কিন্তু পাচ্ছি কোথায় বলুন?
ডাক্তার বললো, কেন দুষ্টুমি করছেন? সোজা কথায় বলুন না প্রেমে পড়েছি, পরে বিয়ে করবো।
আমি বললাম, ডাক্তার ফর গডস সেক হোন্ড ইওর টাংগ। এমন ভাবে জেরা করলে নার্ভাস হয়ে আমি সব কিছু বলে ফেলব।
ডাক্তার শুধু মুচকি হেসে বললো, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় যে আপনি বেশ দুষ্ট লোক, বুঝলেন?
আমাদের নাইল হিলটন হোটেলের পাশ দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নাইল নদী যেমন ধীরে ধীরে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছিল, আমাদের আলোচনাও তেমনি ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য বন্ধনের দিকে টেনে নিয়েছিল।
ডাক্তার একবার জানলা দিয়ে বাইরের বিরাট আকাশের দিকে চাইল, একবার আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিলো। একটু চুপ করে রইল। তারপর নরম গলায় বললো, একটা কথা বলবো?
নিশ্চয়ই। একটা কেন একশোটা বলুন।
দুঃখ পাবেন না?
না, না, দুঃখ পাব কেন? আপনার যা ইচ্ছা বলুন।
ডাক্তার একটু চুপ করে গেল। তারপর প্রায় এক নিঃশ্বাসে হঠাৎ বলে ফেলল, আমি মুসলমান, আমি ইস্ট পাকিস্তানের লোক।
কেন জানি না, এক মুহূর্তের জন্য আমার বুকের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে গেল কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। সহজ হয়েই বললাম, তাতে কি হয়েছে? বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই কায়রোতে বসে আজ আমার কাছে আপনার একমাত্র পরিচয় আপনি বাঙ্গালী। সুতরাং আপনি হিন্দু কি মুসলমান, আপনার বাড়ি বাঁকুড়ায় কি বগুড়ায়–তাতে আমার কিছু যায় আসে না।