বিকেলবেলায় গ্রাম দেখতে বেরুলাম। সবাই ভেবেছিলেন সন্ধ্যার আগেই আমি শহরের দিকে রওনা হবে। কিন্তু বেড়িয়ে এসে জানালাম, গ্রামটাকে ভালবেসে ফেলেছি। কদিন থেকে যাব। রায়বাবুদের বললাম, তাছাড়া পর পর দুটি দারোগা খুন হওয়ায় গ্রামের লোকের মনে একটু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, সুতরাং আমি থাকলে হয়তো তাদের আস্থা ফিরে আসবে।
মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলাম। মনে হলো ছোটবাবু ও ছোট গিন্নীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। কিন্তু মুখে অবশ্য সবাই অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
কাপুর সাহেব তার অতীত জীবনের কথা বলতে গিয়ে একটু পায়চারী করে নিলেন। একটু হাসলেন, একটু ভাবলেন, একটু যেন তলিয়ে গেলেন।…
জানো জার্নালিস্ট, ছোটবাবু জমিদারীর জরুরী কাজে গ্রামান্তরে গেলেন সে রাত্রে। যাবার সময় ছোট-বৌকে বিশেষ করে অনুরোধ করে গেলেন আমার দেখাশুনা করতে।
একটু পরেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গ্রামের দুচারজন গণ্যমান্য ব্যক্তি কাপুর সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে বিদায় নিলেন।
ছোট-বৌ নিজে তদারক করে কাপুর সাহেবকে ডিনার খাইয়ে বিদায় নিলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, আমি ঐ বারান্দার কোণার ঘরে থাকব। যদি কোন দরকার হয়, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ডাকবেন।
-না না কিছু দরকার হবে না, আপনি এবার বিশ্রাম নিতে যান।
হাসিমুখে হাত জোড় করে নমস্কার করে ছোট-বৌ বিদায় নিলেন। বারান্দার ঝড় লণ্ঠনগুলো নিবিয়ে দিয়ে চাকরবাকরের দলও বিদায় নিলো। আরো কিছুক্ষণের মধ্যে সারা জমিদার বাড়ীই নিঝুম হয়ে পড়ল। সারা দিনের অসংখ্য মানুষের কলকোলাহল রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে হারিয়ে গেল।
টিপটিপ বৃষ্টি আর জলো-হাওয়ার বেশ একটু ঠাণ্ডা আমেজ ছিল সে রাত্রে। ঘুমটা বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু হঠাৎ ভয়ে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। সারা আকাশ ভরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। পায়ের দিকের জানলা দিয়ে একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে।
কাপুর সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন, প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? আপনি?
সে রাত্রের প্রতি মুহূর্তের কাহিনী শোনার নয়, শোনাবারও নয়। প্রখ্যাত জমিদার রায়বাড়ীর ছোট-বৌ সেদিন সে রাত্রে ধীরে ধীরে কিভাবে তার দেহের, মনের, সংস্কারের, ঐতিহ্যের বন্ধন খুলে দিয়ে ছিলেন, সে কাহিনীর পূর্ণ বৃত্তান্ত আজও বলতে গেলে কাপুর সাহেবের গলা শুকিয়ে আসে, চোখ-মুখ-কান লাল হয়ে ওঠে।
আমার দিক থেকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলেন কাপুর সাহেব। ছোট টিবেটিয়ান কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বললেন, জার্নালিস্ট, তুমি আমার ছেলের বয়সী, মুশকিল সেইখানে…
কয়েক মুহূর্তের জন্য আবার একটু তলিয়ে গেলেন কাপুর সাহেব।
…ধীরে ধীরে তিলে তিলে একটু ছোঁয়া, একটু হাসি, একটু আদর, একটু ভালবাসার খেলা খেলে ছোট-বৌ আমাকে গ্রাস করল। আমার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান পুড়ে ছারখার হয়ে গেল, আমার বিদ্যা-বুদ্ধি, ন্যায় অন্যায় জ্ঞান বিদায় নিল।
ভোরবেলায় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে নিজের বিছানায় ছোট-বৌকে দেখে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। ছোট বৌ কিন্তু চমকে ওঠেনি।
…ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, এ বাড়ীর কর্তারা নিজের বাড়ীতে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিন ভালবাসার অভিনয় করেন কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার হতে না হতেই খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায়। একটু মুচকি হেসে বলেছিল, কিন্তু এ বাড়ীর গিন্নীরাও সন্ন্যাসিনী নয়।
দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করেই শহরে যাবার পরিকল্পনা ছিল কাপুর সাহেবের, কিন্তু সুরমা-মাখা বাঁকা চোখের হাসি দিয়ে ছোট বৌ তাঁর সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিলেন। আরো কটি রাত্রি রায়বাড়ীর অতিথিশালায় ছিলেন তিনি। রাত্রির অন্ধকারে দেহের, মনের সমস্ত বন্ধন যখন শিথিল হয়েছিল, তেমনি এক দুর্বল মুহূর্তে ছোট-বৌ বলেছিলেন, রাত্রের অন্ধকারে যখন আমরা শিকারের খোঁজে বেরিয়ে থাকি, তখন কোন বাধা-বিপত্তি গ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না। রায়বাড়ীর বাবু বা গিন্নীদের হাতে দুচারজন ভাগ্যবান প্রজার স্বর্গবাস হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।
কাপুর সাহেব একথার তাৎপর্য বুঝেছিলেন; বুঝেছিলেন ইদানীংকালের দুটি খুনের রহস্য। দুর্বলতাবোধ করেছিলেন রহস্য উদ্ধারের কাজে এগুতে।
সেই হলো শুরু।
পরবর্তী কালে কর্মব্যপদেশে প্রায় সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন কাপুর সাহেব। অর্থ, প্রতিপত্তি, মর্যাদার জন্য কাঙাল হয়ে কত অসংখ্য মানুষ এসেছেন তাঁর কাছে। একটা লাইসেন্স, পারমিট, বে-আইনী কাজ করে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষকে অমানুষ হতে দেখেছেন তিনি। প্রথম প্রথম বিবেক বিদ্রোহ করেছে, মন সায় দেয়নি। ছোট-বৌ-এর স্মৃতিকে নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিলেন কাপুর সাহেব। সে স্মৃতি তিনি মুছে ফেলেছিলেন মন থেকে। নিষ্ঠাবান স্বামীরূপে, স্নেহশীল ও দায়িত্বশীল পিতারূপে তিনি সারা সংসারের প্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে, তিলে তিলে অদৃশ্য ক্ষয়রোগের মতো সমাজের মানুষ তার সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে সারা সংসারে। স্ত্রীর ভালবাসা, পুত্রের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন তিনি।
কাপুর সাহেব বারান্দা থেকে লনে নেমে একটু পায়চারী করে গোটাকতক ক্রিসানথিমাম্ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন মাটিতে।