মিঃ দত্ত চোখ দুটোকে সরিয়ে নিলেন, দৃষ্টিটা লম্বা রাণওয়ে ছাড়িয়ে আরো অনেক অনেক দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর একটু নরম গলায় ভেজা ভেজা স্বরে বললেন, এই দুনিয়াটাও তো একটা বড় ধরনের ট্রানজিট লাউঞ্জ। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে; কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। কারুর প্লেন পনেরো মিনিট পরে, আবার কারুর প্লেন দুচার ঘণ্টা পরে। তবে যাবে সবাই, থাকবে না কেউ। তাইতো ভাবি, আমিও একদিন চলে যাব, চলে যাবে লতা। হয়তো আমার প্লেন আগে, লতার প্লেন পরে। কিন্তু সব যাত্রীকেই তো একদিন একটা জায়গায় মিলতে হবে…..
মাইক্রোফোনে হঠাৎ ঘোষণা শোনা গেল, প্যাসেঞ্জার্স ট্রাভেলিং টু নিউইয়র্ক বাই এয়ার ইণ্ডিয়া ফ্লাইট ওয়ান জিরো থি, আর রিকোয়েস্টেড টু প্ৰসিড টু…
মিঃ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। আমার হাতে হাত দিয়ে বললেন, চলি স্যার! হয়ত আবার কোনদিন এমনি ট্রানজিট লাউঞ্জে দেখা হবে। গুড বাই।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। যখন হুঁস হলো তখন দেখি এয়ার ইণ্ডিয়া বোয়িং আকাশে উড়ে গেছে।
৩. সতী সাধ্বী নারীর জীবনে সিঁথির সিন্দুর
সতী সাধ্বী নারীর জীবনে সিঁথির সিন্দুর সব চাইতে গর্বের ধন; রাজধানীর সামাজিক জীবনে ফ্রেণ্ডস কলোনীতে বাস করা তার চাইতে অনেক বেশী গর্বের, অনেক বেশী সম্ভ্রমের। ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভের ছেলেমেয়েরা অশোকা হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়, জিমখানা ক্লাবে টেনিস খেলে, কিন্তু ফ্রেণ্ডস কলোনীর ছেলেমেয়েদের এত বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয় না। সামনের লনের বাঁ দিকে টেনিস কোর্ট, ভিতরের লনের ডান দিকে সুইমিং পুল অনেক বাড়ীতেই পাওয়া যাবে। সারা ফ্রেণ্ডস কলোনীতে একটি দোতলা বাড়ী নেই, কিন্তু কোন বাড়ীর দক্ষিণাই হাজার চারেকের নীচে নেই বললেই চলে। বাংলা সরকারের হেড এ্যাসিস্ট্যান্টের চাইতে এখানকার বাবুর্চির মাইনে বেশী, ডেপুটি সেক্রেটারীর চাইতে ভাল পোষাক পরে, অনেক ভাগ্যবান সেক্রেটারীর চাইতে বেশী দেশ ঘুরছে।
ফ্রেণ্ডস কলোনীর বাসিন্দাদের নাম খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পাওয়া যায় না। মাঝে-মাঝে আইন-আদালতের কলমে বা কোম্পানীর নোটিশের মধ্যে পাওয়া যায়। এরা অনেকেই মন্ত্রীদের বক্তৃতা পড়েন না, কিন্তু ফিনান্স মিনিষ্ট্ৰী বা উদ্যোগ ভবনের আণ্ডার সেক্রেটারীদের জন্মদিন পালন করেন লুকিয়ে লুকিয়ে।
রাজধানী দিল্লীতে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের তীর্থক্ষেত্র ছিল তখন গলফ, লিঙ্ক জোড়বাগ–ডিফেন্স কলোনী–ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভ বা ফ্রেণ্ডস কলোনর জন্ম হয়নি, তিন-চার কি পাঁচ হাজার টাকা বাড়ী ভাড়া দেবার প্রশ্ন ওঠেনি। দেশের হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে, সোস্যালিজমের ঝড় ওঠবার পর ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভ ফ্রেণ্ডস কলোনীর সৃষ্টি হলো, হাজার-হাজার টাকা বাড়ী ভাড়া দেবার খদ্দেরেরও অভাব ঘুচল।
দিল্লীর সমাজ-জীবনের এ হেন ফ্রেণ্ডস কলোনীতে মিঃ কাপুরও বাস করতেন। যাঁরা দূর থেকে তাকে দেখেছেন, দেখেছেন ফ্রেণ্ডস কলোনীর জীবনকে, তারা জানেন, বিশ্বাস করেন কাপুর সাহেবের জীবনে শুধু আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। দিল্লীর মানুষ বিশ্বাস করে ফ্রেণ্ডস কলোনীর জীবনে কোন দুঃখ, কোন হতাশা, কোন দীর্ঘ নিঃশ্বাস থাকতে পারে।
কিন্তু ফ্রেণ্ডস কলোনীর কাপুর সাহেব জীবনের শেষ দিনগুলিতে চোখের জলের বন্যা বইয়েছেন, বুকের মধ্যে অসহ্য জ্বালা উপলব্ধি করেছেন। শুধু কি তাই? মানুষ দেখলে ভয় পেয়েছেন, সুন্দরী যুবতী দেখলে শিউরে উঠেছেন, মদের গেলাস দেখলে ছুটে পালিয়েছেন। রাত্রিতে ঘুমিয়েও শান্তি পাননি কাপুর সাহেব। ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়েছে অতীত দিনের স্মৃতি। তিরিশ বছরের অতীত স্মৃতির জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে ঘরে এসেছেন রায়বাড়ীর ছোট-বৌ………
…বিলেত থেকে ফেরার পর আমাকে বর্ধমান, চট্টগ্রাম, বরিশাল ঘুরিয়ে প্রথম ইণ্ডিপেন্টে চার্জ দিল খুলনায়। আজকের মত তখনকার দিনে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের অত ঝামেলা পোহাতে হতো না। আইন শৃঙ্খলা করাই ছিল প্রথম ও প্রধান কাজ। খুলনায় এসব ঝামেলা একটু কমই ছিল এবং প্রথম কয়েকটা মাস ভালই কাটল। কিন্তু তারপর এক অতি বর্ধিষ্ণু গ্রামে পর পর দুটি খুন হওয়ায় পরিস্থিতি বেশ একটু জটিল হলো। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে মনে হলো স্বদেশীওয়ালাদের কাজ নয়। সরকার ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। আমার উপর আদেশ হলো একটু ব্যক্তিগত নজর রাখতে। কমাস আরো কেটে গেল।
এরপর একদিন নিমন্ত্রণ এলো ঐ গ্রামের উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব করতে। নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। ঠিক করলাম ঐ গ্রামে কয়েক দিন থাকব, কিন্তু কাউকে জানালাম না।
যথারীতি অন্যান্য ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো আমারও থাকার ব্যবস্থা হলো রায়বাড়ী। মহাসমারোহে আমাকে অভ্যর্থনা করা হলো। কয়েক হাজার গ্রামবাসীর সামনে বায়বাড়ীর তিন বাবু ও তিন গিন্নী আমাকে নতুন জামাই-এর চাইতেও অনেক বেশী সমারোহে বরণ করলেন। ছোটবাবু বেশ সৌখীন মানুষ; সন্ধ্যার পর একটু নাচ-গানেরও আয়োজন করেছিলেন।
পরের দিন সকালে পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব করলাম। সভার শেষে স্কুলের জন্য সরকারী তহবিল থেকে পাঁচ হাজার টাকা দান করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় গ্রামের আপামর সাধারণ আমার মহানুভবতায় মুগ্ধ হলো।