বল না খোকনদা।
তুই রাগ করবি না?
তুমি পাগল হয়েছ! তোমার কথায় রাগ করব?
অনেক দিনের অনেক দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে যুবক দত্তসাহেব সেদিন সতাকে বলেছিলেন, লতা, তুই আমাকে বিয়ে করবি?
দত্তসাহেব লক্ষ্য করেনি এক মুহূর্তে লতার মুখের চেহারাটায় আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন হয়েছিল; দত্তসাহেব সেদিন খেয়াল করেননি, লতা ঠোঁট কামড়ে অবাক হয়ে তার খোকনদার দিকে চেয়েছিল। নিরুত্তর লতাকে আর একবার হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে উত্তর দিচ্ছিস না যে?
লতা সেদিন শুধু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। দত্তসাহেব ভেবে ছিলেন লজ্জায় লতা উত্তর দিতে পারেনি, পরে দেবে। দিনকতক পরে আর একবার লতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে লতা, সেদিন যা জিজ্ঞেস করলাম, তার তো কোন জবাব দিলি না।
কি উত্তর দেব খোকনদা?
আর একটু চাপ দেবার পর লতা বলেছিল, তা হয় না খোকনদা!
ছাত্রজীবনে খুব ভাল ছেলে না হলেও ফেল করার মতো ছাত্র ছিলেন না দত্তসাহেব কিন্তু তবুও তিনি বিএ পরীক্ষায় ফেল করলেন। পরীক্ষায় ফেল করার অজুহাতে দত্তসাহেব বাঁড়ুজ্যে বাড়ী যাওয়া বন্ধ করলেন। ছোটবেলা থেকে অনায়াসে যে খোকনদাকে লতা পেয়ে এসেছে, তাঁর মূল্য সে আগে উপলব্ধি করতে পারেনি।
যখন উপলব্ধি করল, কি যেন সে হারিয়েছে, কোথায় যেন তার ছন্দ-পতন ঘটেছে, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কোথায় যেন কিসের অভাব হচ্ছে, তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। আশীর্বাদ হবার দিন একবার নয়, বারবার মনে হয়েছিল খোকনদার কাছে ছুটে পালায়, কিন্তু দ্বিধা, সঙ্কোচ, ভয়, সংস্কার লতাকে টেনে রেখেছিল। শ্রীরামপুরের অনাথ চক্রবর্তীর গলায় মালা পরাবার আগে একবার বিদ্রোহ করবার ইচ্ছা হয়েছিল তার, কিন্তু পারেনি।
ছোটবেলা থেকে মনের দোসর হওয়া সত্ত্বেও সেদিনের অনভিজ্ঞ যুবক খোকনদা তাঁর লতার মনের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা জানতে পারেনি। তাইতো সে লতার অবজ্ঞাকে সহ্য করতে পারেনি, বালীগ্রাম ত্যাগ করে পৃথিবীর জনারণ্যে সে নিজেকে মিশিয়ে দেবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছিল।
সেদিনের বালীগ্রামের প্রায় অজ্ঞাত অপরিচিত ব্যর্থ প্রেমিক যুবক তমাল দত্ত প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে আগামী দিনের দিকে এগিয়ে যাবার পথে প্রতি পদক্ষেপে সার্থক হয়েছে। এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ফার্ম খুলেছেন, হয়ত কোটি টাকাই রোজগার করেছেন। একদিন একটি নারীর কাছে অবজ্ঞা পেলেও পরবর্তীকালে ব্যবসা বাণিজ্য অর্থ-প্রতিপত্তির সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অনেক, অনেক নারী এসেছে তাঁর জীবনে। অদৃষ্টের চাকা আরো অনেকখানি ঘুরেছিল।
তাইতো একদিন লতাও এসে হাজির হয়েছিল রাসেল স্ট্রীটে তমাল দত্তের অফিসে। কাজের ভীড়ে, ফাইল পত্তরের চাপে ভিজিটার্স দেখার যখন সময় হলো তখন প্রায় পৌণে-পাঁচটা বাজে। লতাকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে মিঃ দত্ত চমকে গিয়েছিলেন। প্রথম দু-চার মিনিট দুজনের কেউই কথা বলতে পারেনি। নির্বাক দুটি মানুষ সেদিন অস্তগামী সূর্যের করুণ রশ্মির মুখোমুখি হয়ে বহু দূরে ফেলে আসা অতীত স্মৃতির মধ্যে ডুব দিয়েছিল। লতা চোখের জলের বন্যা বইয়েছিল, নিজের মনের অন্তর্দ্বন্দ্বের গোপন ইতিহাসের খুঁটিনাটিও বলেছিল তার খোকনদাকে। আর শুনিয়েছিল তার ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের করুণ ইতিহাস।
মিঃ দত্ত চোখের জল ফেলেনি, কিন্তু পাতা দুটো ভিজে উঠেছিল। বেশী কথা বলতে পারেনি। তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে শুধু বলেছিলেন, লতা, ভুলে যেও না একদিন তোমাকে ভালবাসতাম হয়তো আজও ভালবাসি। তোমার চোখের জল দেখলে আজও আমার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয়। হয়তো তোমারই কথা ভেবে নিজের জীবনে আর কোন মেয়েকে ঠাঁই দিতে পারলাম না। একটা মোটা ভারী দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, যাক সেসব কথা। তুমি যে তোমার খোকনদাকে ভোলনি, সেজন্য ধন্যবাদ, আর ভবিষ্যতে যদি মনে কর তবে মনে করব অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও কিছুটা সার্থকতা পেলাম।
ওয়ালডর্ফ হোটেলে বসে বসে বহু আলোচিত এই মানুষটির জীবনকাহিনী শুনতে-শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর একটা নতুন বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে মিঃ দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা স্যার, এত মদ খাই, এত মেয়েকে নিয়ে খেলা করি কিন্তু তবুও কেন লতাকে ভুলতে পারি না বলতে পারেন? বলতে পারেন অনেক স্মৃতির তলা থেকে ঐ স্মৃতিটাই বারবার কেন উঁকি দেয়?
প্রেম শাস্ত্রে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমিত। তাছাড়া তমাল দত্তের জীবনকাহিনী শুনে নিজের মনের মধ্যেও যেন একটা নাড়া খেয়েছিলাম। শুধু বললাম, কেউটে সাপের বিষের জ্বালা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে, কিন্তু এ বিষের জ্বালা তো কোনদিন যায় না।
দুদিন পরে মিঃ দত্ত নিউইয়র্ক রওনা হলেন। আমিও ঐদিনই দিল্লীর পথে রোম রওনা হলাম। আমার প্লেন দেরীতে ছাড়লেও দত্তসাহেবকে বিদায় জানাবার জন্য একই সঙ্গে এয়ারপোর্ট এলাম। দুজনেই লগেজ চেক আপ করে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢুকলাম। দুবোতল বিয়ার নিয়ে দুজনে এক কোণায় বসলাম। মিঃ দত্ত একটু হাসলেন, তলিয়ে গেলেন অতীত স্মৃতির ভীড়ে। আর এক সিপ বিয়ার খেয়ে বললেন, জানেন স্যার, এই ট্রানজিট লাউঞ্জ আমার বড় ভাল লাগে। কত বিচিত্র দেশের বিচিত্ৰতর মানুষ এখানে কিছু সময়ের জন্য আসছেন। কেউ এক পেগ হুইস্কি, কেউ এক গেলাস বিয়ার, কেউ বা এক কাপ চা বা কফি নিয়ে বসে থাকেন। কেউ হাসছেন, কেউ ভাবছেন, কেউ বা হয়তো আমারই মতো কোন জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরছেন। কেউ হয়তো বিয়ে করতে যাবার আনন্দে প্লেন ধরার জন্য এখানে অপেক্ষা করেন, আবার কেউ হয়ত প্রিয়তম মানুষের ফিউনারেলে যোগ দেবার জন্য প্লেনের পথ চেয়ে বসে থাকেন।