- বইয়ের নামঃ আকাশ-ভরা সূর্য-তারা
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
» ১. আদিকালে রাজা-মহারাজা
আকাশ-ভরা সূর্য তারা – নিমাই ভট্টাচার্য
আকাশ-ভরা সূর্য-তারা, বিশ্ব প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।……
জীবনে অনেক কিছু করেছি। যা করিনি, তা হচ্ছে বাপ-ঠাকুরদার পদাঙ্ক অনুসরণ। সংসারের আর পাঁচজনের মতো ভালহৌসী স্কোয়ারে চাকরি নিলাম না। পরমাত্মীয়দের বিয়েতে বরযাত্রী গেলাম না, বৌভাত খেলাম না। একটা তাঁতের শাড়ী বা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি বা টেবিল ল্যাম্পও প্রেজেন্ট করতে পারলাম না। অফিসের পশ্চিমী দারোয়ানের কাছ থেকে পনেরো টাকা ধার করে জামাই ষষ্ঠীর দিন সিল্কের পাঞ্জাবি চড়িয়ে অরক্ষণীয়া শালীকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ারকি করার দুর্লভ সুযোগও এলো না জীবনে।
আরো অনেক কিছুই হলো না এই জীবনে। জিমন্যাষ্টিক প্লেয়ারদের মতো এক আঙ্গুলের ‘পর সমস্ত দেহের ভর রেখে বাসে চড়ে ঘুরে বেড়ানো দেখাতে পারলাম না, পাঁচ টাকা ইনক্রিমেন্টের জন্য দেড় বছর ধরে আন্দোলন করতে পারলাম না, সাত্ত্বিক ভোজপুরী ব্রাহ্মণ পুলিশ কনষ্টেবলের পবিত্র লাঠির ঠেঙানি খেয়ে শহীদ হওয়াও সম্ভব হলো না। ধাপার কপি, বনগাঁর কাঁচাগোল্লা, কেষ্টনগরের সর ভাজা, মালদার ফজলিও কপালে জুটল না। বিজয়া দশমীর পর গুরুজনদের প্রণাম করে নারকেলের ছাপা সন্দেশ না খেতে পারার জন্যও কি কম দুঃখ হয়?
এসব কিছুই হলো না কিন্তু বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্রের বাংলাদেশে থাকলে আরো কিছু কিছু সম্ভাবনা ছিল। শিক্ষাবিদ হলে শ্রমিকদের মতো তিন-শিফট-এ কাজ করার দুর্লভ সুযোগ পেতাম, সর্বত্যাগী রাজনীতিবিদ হলে বিনা রোজগারেও বেশ মেজাজের সঙ্গে সঙ্গে সংসার চালাতে পারতাম, উদভ্রান্ত শ্রমিক নেতা হলে আমার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও অপগণ্ড ভাইপো গুলোকে কল-কারখানার মালিক নিশ্চয়ই জোর করে চাকরি দিত। পোড়া কপালে তাও হলো না।
মোন্দাকথায় ঠিক মধ্যবিত্ত ভদ্দরলোক বলতে যা বোঝায়, আমি তা হলাম না বা হতে পারলাম না। কেউ বলেন ম্লেচ্ছ হয়েছি, কেউ বলেন গোল্লায় গেছি। আমি নাকি যা-তা খাই, যেখানে-সেখানে যাই, যাঁর-তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। অভিযোগগুলো যে মিথ্যে, তা নয়। কখনও জীবিকার তাগিদে, কখনও জীবনের প্রয়োজনে মিশেছি অনেকের সঙ্গে। মিশেছি বড়লোক, ভদ্দরলোক, ছোটলোকের সঙ্গে। মিশেছি পুরুষের সঙ্গে, মেয়েদের সঙ্গে। তবে তারা সবাই মানুষ। জীবনের টানে, জীবিকার গরজে ঘুরেছি সারা ভারতবর্ষ, ঘুরেছি এশিয়ার নানা দেশ। পাড়ি দিয়েছি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা।
ছোট্ট ঘরে নিশ্চিন্ত জীবন আমি পাইনি। ঘরের থেকে বেরিয়ে এসে বিরাট আকাশের তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছে আমাকে। ঘরের কোণে ছোট্ট প্রদীপের আলোয় অদৃষ্টের খেয়াঘাট খুঁজে পাইনি। শেষে আকাশ ভরা সূর্য-তারার আলোয় চিনে নিয়েছি সে খেয়াঘাট। তাইতো মনে হয় ভালবেসেছি আকাশ-ভরা সূর্য-তারাকে। আশঙ্কা হয় এই আকাশের কোন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছোট্ট ঘরের নিশ্চিন্ত পরিবেশে নিজেকে কোনদিনই বন্দী করতে পারব না।
আমার এই আকাশ-ভরা সূর্য-তারার সঙ্গে যদি অন্য কারুর আকাশের সূর্য তারার কোন মিল থাকে, তবে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা।
–নিমাই ভট্টাচার্য
.
১.
আদিকালে রাজা-মহারাজা, বাদশা-শাহেনশার দরবারে সভাকবির দল থাকতেন। তাঁরা রাজার কথা লিখতেন, ছোটরাণী, বড়রাণীর কথা লিখতেন। লিখতেন আরো কিছু। লিখতেন রাজ্যের কথা, রাজ্যশাসনের কথা, রাজ্যের খ্যাতিমান পুরুষদের কথা। আর লিখতেন রাজার মহানুভবতার, রাণীমার ঔদার্যের কাহিনী। মাঝে মাঝে রাজকুমারের মৃগয়ার কথা বা অষ্টাদশী পূর্ণযুবতী রাজকুমারীর রূপ-যৌবনের কাহিনী নিয়েও সভাকবির দল লিখতেন। সময়ে অসময়ে আরো অনেক কিছু লিখতে হতো। শত্রুপক্ষের নিন্দা করে কাব্যরচনা করতে হতো সভাকবিদের। কখনো-কখনো সুরাপানের প্রয়োজনীয়তা বা উপকারিতা নিয়েও লিখতেন তাঁরা। রাজার মনোরঞ্জনের জন্য দেহপসারিণী নাচিয়ে-গাইয়েদের নিয়েও চমৎকার কাব্যরচনা করে গেছেন অতীত যুগের ঐ সভাকবির দল।
অতীতকালের ইতিহাসের টুকরো-টুকরো ছেঁড়া পাতাগুলো খুঁজলে সভাকবিদের বিস্ময়কর প্রতিভার আরো অনেক পরিচয় পাওয়া যাবে। এইসব সভাকবিদের টুকরো টুকরো কাব্যকে অবলম্বন করে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা ইতিহাস লিখেছেন। সে ইতিহাস আমরা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করেছি, কিন্তু ভুলে গেছি সভাকৰিদের। শুধু যে তাদের আমরা ভুলে গেছি, তা নয়। সভাকবিদের জীবনকাহিনী সম্পর্কে আমাদের অবজ্ঞা আমাকে বড় পীড়া দেয়; সভাকবিদের রচনা নিয়ে আমরা হৈ-চৈ করি, কিন্তু তাদের জীবনে কোনদিন সুখ-দুঃখ ভালবাসা-ব্যর্থতা নিয়ে আলো-আঁধারের খেলা হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। সভাকবিরা সব কিছু লিখেছেন, লেখেননি শুধু নিজেদের কথা। হয়তো নিজেদের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালবাসার জ্বালায় তাঁরা জ্বলেপুড়ে মরেছেন, কিন্তু সে কাহিনী লেখার সুযোগ কোনদিন তাঁদের জীবনে আসেনি।
আমরা খবরের কাগজের রিপোর্টাররাও হচ্ছি এযুগের সভাকবির দল। আমরাও রাজার কথা লিখি, মন্ত্রীর কথা লিখি, রাজার মহানুভবতা রাণীমার ঔদার্যের কথা, রাজ্যের কথা, রাজার বন্ধুদের কথা লিখি। অতীতের সভাকবিদের কাব্যের মতো আজকের দিনের খবরের কাগজের রিপোর্টারদের টুকরো-টুকরো রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আগামী দিনের ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই আজকের ইতিহাস লিখবেন। আগামী দিনের মানুষ সে ইতিহাস হয়তো মুগ্ধ হয়ে পড়বেন, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও কেউ স্মরণ করবেন না রিপোর্টারদের।