***
তুমি বিশ্বাসঘাতককে ঘৃণা করো। তাই না রোনাটা? আগে আমার কথা সবটা শোনো। তারপর জানিও আমাকে ঘৃণা কর কি না।
আমি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় এ-কাজ করেছি। অর্থের লোভে নয়, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়। তবে কেন? কেন?
আমেরিকা আজ বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের একচেটিয়া মালিক। মনোপলি বিজনেস! গর্বে তার মাটিতে পা পড়ে না। ধরাকে সে সরা জ্ঞান করছে। কিন্তু কে তার হাতে তুলে দিল এই সম্পদ? কারা? তাদের কয়জন আমেরিকান?
যে ছয়জন প্রাকযুদ্ধ-যুগে ওই সম্ভাবনাময় প্রথম পাঁচটি দুরূহ সোপান অতিক্রান্ত করেছিলেন তাদের একজনও মার্কিন নন–রাদারফোর্ড, চ্যাডউইক, কুরি-দম্পতি, ফের্মি আর অটো হান! ইংল্যান্ড; জার্মানি; ফ্রান্স; ইতালি; আবার জার্মানি! আমেরিকা কই? তারপর দেখ–ওই পাঁচজনের প্রাথমিক নির্দেশ সম্বল করে যে বৈজ্ঞানিক দল হাতে-কলমে পরমাণু বোমাকে বাস্তবায়িত করলেন তারাও অতলান্তিকের এ পারের মানুষ। নীলস বোহর, হান্স বেথে, জেমস্ ফ্রাঙ্ক, এনরিকো ফের্মি, উরে, ৎজিলাৰ্ড, টেইলার, উইগনার, ফন নয়ম্যান, ক্রিস্টিয়াকৌস্কি, রোবিনভি, ওয়াইস্কফ, চ্যাডউইক, ক্লাউস ফুস্ক ই? মার্কিন নাম কই? লরেন্স, কম্পটন ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কজন সাচ্চা বিজ্ঞানী ছাড়া আছেন একমাত্র ‘অ্যাটম-বোমার জনক’ ওই ওপেনহাইমার। তার অবদানের কথা সৌজন্যবোধে আর নাই বললাম।
তাহলে? এ অস্ত্রের ওপর আমেরিকার একচ্ছত্র মালিকানা হল কোন যুক্তিতে? যুক্তি একটাই–ক্যাপিটালিস্টের যুক্তি! আমেরিকা টাকা ঢেলেছে। ক্যাপিটাল জুগিয়েছে। ওইসব বিদেশি বৈজ্ঞানিকরা কারখানা-মজদুর বৈ তো নয়? যুক্তিটা তো এই? আমি এই যুক্তি মানতে পারিনি। তুমি পারছো?
দ্বিতীয়ত। বিশ্বাসঘাতক কে, বা কারা? আমাদের বলা হয়েছিল জার্মান জুজুর ভয়েই এই বোমা বানানো হচ্ছে। আসলে আমাদের প্রতিযোগী ছিল চারজন জার্মান বৈজ্ঞানিক-অটো হান, ওয়াইৎসেকার, ফন লে আর হেইজেনবের্গ। আমরা য়ুরোপখণ্ডের বিদেশি বিজ্ঞানীরা–কর্তৃপক্ষের মুখের কথায় বিশ্বাস করে প্রাণপাত খেটেছি পুরো ছটি বছর। কারখানা থেকে লভ্যাংশ যখন ঘোষিত হল তখন মিলমালিক মজদুরদের মুখে লাথি মেরে গোটা লভ্যাংশটাই পকেটজাত করলেন। অ্যাটম বোমা ফেলা হবে কি হবে না সে বিষয়ে আমাদের আর কথা বলার কোন। অধিকার রইল না। ৎজিলাৰ্ড দোরে দোরে মাথা খুঁড়ে মরেন বৃথাই, ফ্রাঙ্ক-রিপোর্ট এর স্থান হল ছেঁড়া-কাগজের ঝুড়িতে, প্রফেসর নীলস বোহরের মতো বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিককে চার্চিল মুখের ওপর বললে–লোকটা কী বকছে? রাজনীতি না পদার্থবিদ্যার কথা? স্বয়ং আইনস্টাইনের দ্বিতীয় চিঠিটা–যা তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে লিখেছিলেন অ্যাটম বোমা না ফেলার জন্য তাকে ট্রুম্যান কোনো মূল্যই দেননি!!
তৃতীয়ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাপান যদি এশিয়াবাসী না হত, পীতবর্ণের পৃথক জাতি না হত, তাহলে ট্রুম্যানগ্রোভ-ওপি এভাবে পৈশাচিক উল্লাসে উন্মত্ত হত না। আমার বাবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী–আমি বিশ্বসাম্যবাদের। আমি ওদের ক্ষমা করতে পারি না।
চতুর্থত। ক্লাউস ফুকস্ যে অপরাধে বিশ্বাসঘাতক, সে অপরাধে গোজেঙ্কো কেন বিশ্বাসঘাতক নয়, তা আমাকে বোঝাতে পার? সেও কি গোপন তথ্য শত্রুপক্ষকে ফাঁস করে দেয়নি? অথচ তার তো বিচার হল না? কেন? সে ক্যাপিটালিজম-এর দালাল বলে? এই বোধহয় ওদের আইনের নির্দেশ! হিটলার পরাজিত না হলে–ওই ন্যুরেমবার্গে হয়তো বিচার হত গ্রোভস্ আর ট্রুম্যানের! আইকম্যানের সঙ্গে ওদের তফাত কোথায়?
সবচেয়ে দুঃখ কী জান, রোনাটা? এত করেও কিছু হল না। আমার সাধের। জার্মানি আজ দু টুকরো! বার্লিনের মাঝখান দিয়ে উঠেছে কাঁটাতারের বেড়া। যে স্তালিনের রাশিয়ার জন্য কাণ্ডটা করলাম সেও আজ হিটলার হতে বসেছে। পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়ায় দেখেছি তার স্বরূপ! কাপিৎজা আজ সাইবেরিয়ায় বন্দী!
“এ আমরা কী করলাম! কমরেড! এ তুমি কী করলে!”
***
ওরা বলে–বিংশ শতাব্দীর ‘জুডাস’। বিশ্বাস কর রোনাটা–
আমি জুডাস নই, আমি প্রমিথিউস! প্রমিথিউস কে জান? অ্যাটলাসের ভাই। অ্যাটলাস জগদ্দল বোঝা বইছে নির্বিকারে–কিন্তু প্রমিথিউস হচ্ছে আদিম বিদ্রোহী। স্বর্গাধিপতি ‘জিউস’-এর গোপন গুহা থেকে সে চুরি করে এনেছিল অগ্নিশিখা। যে আগুন আলো দেয়, যে আগুন উত্তাপ দেয়। মানুষের কল্যাণে, পৃথিবীকে প্রথম আলোকিত করেছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরা পড়ে যায়। জিউস তাকে পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে শৃঙ্খলিত করে–ঈগল পাখি দিয়ে তার যকৃৎ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ায়। আমাকে ওরা অবশ্য ধরতে পারেনি, আমি নিজেই ধরা দিলাম। স্বেচ্ছায়।
লিজা পাগল হয়ে গিয়েছিল। মাও পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বাস করো রোনাটা, আমি কিন্তু পাগল হইনি। জানি, এ স্বীকারোক্তির পরিণাম কী? প্রমিথিউসের শেষ পরিণাম! না! কৃতকার্যের জন্য আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। যা করেছি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় করেছি-সুযোগ পেলে আবার এ কাজ করবো! স্বীকার করছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে-অনুশোচনায় নয়!
***
আমার সামনে এখন খোলা আছে দুটি মাত্র পথ। পটাসিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুল রয়েছে আমার পকেটে। এই রাখলাম টেবিলের ওপর। যারা বিচারের প্রহসন করে আমার যকৃৎ ঈগল দিয়ে খাওয়াবার আদেশ দেবে তারা শুনে রাখুক–অনায়াসে এই মুহূর্তে তাদের হাত এড়িয়ে যেতে পারি আমি। কেন যাচ্ছি না জান? তার দুটি কারণ :