তুমি হয়তো বলবে : ঈশ্বর করুণাময়।
বাবাও তাই বলতেন।
সবচেয়ে বড় কথা, লিজাকে ভুল খবর দেওয়া হয়েছিল। কিটোস্কি আদৌ ধরা পড়েনি। সে আজও বহাল তবিয়তে জীবিত। রাশিয়ায়। বিয়ে-থা করেছে, ঘর-সংসার করছে। শুনে এবারও বাবা বললেন : ঈশ্বর করুণাময়।
মা কিন্তু তা বললেন না। উল্টে এবার তিনি পাগল হয়ে গেলেন। তবে ঈশ্বর করুণাময় বলেই বোধকরি তাকে বেশিদিন কষ্ট পেতে হয়নি। এবার তিনিও আত্মহত্যা করে বসলেন। ল্যাটা চুকে গেলো।
দাদা নিরুদ্দেশ, আমি পলাতক, ক্রিস্টি আমেরিকায়–তা হোক। গোটা পৃথিবীর বোঝা যখন বইতে পারছেন তখন আর এ শাকের আঁটিটাকে কি আর কাঁধে নিতে পারবেন না? বৃদ্ধ অ্যাটলাস মানুষ করতে থাকেন মা-বাবা-হারা বকে। আমার কৌতূহল হয় জানতে ব-এর পড়ার টেবিলের ওপরও কি বাবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী উইলিয়াম টেস্-এর সেই চার-লাইনের কবিতাটি উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন। বও কি মুছে দিয়েছিল দ্বিতীয় লাইনটা?
***
কী কথা যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, লস অ্যালামসের কথা। সেখানে মাস ছয়েক কাজ করার পর কদিনের ছুটি নিয়ে আমি চলে গেলাম ম্যাসাচুসেটসে। সেখানে কেমব্রিজে থাকত ক্রিস্টি আর তার স্বামী হেইম্যান। ক্রিস্টিকে আমি আগেই খবর দিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে ওরা আমায় নিতে এসেছিল। এক মার্কিন বন্ধুর গাড়ি নিয়ে। আলাপ হল মার্কিন ভদ্রলোকটির সঙ্গে। বেশ আমুদে লোক। নাম হ্যারি গোল্ড। দিনসাতেক ছিলাম ক্রিস্টিদের বাড়িতে। ওর মধ্যেই একদিন সুযোগ করে হ্যারি নিরিবিলিতে আমাকে বললে, ডক্টর ফুকস্, দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে নিরিবিলিতে দুটো কথা বলব বলে সুযোগ খুঁজছি।
আমি অবাক হয়ে বলি, বল কী হে! তোমার সঙ্গে আলাপই তো হয়েছে আজ পাঁচদিন।
হ্যারি গোল্ড ঝুঁকে আসে আমার কাছে। প্রায় কানে কানে বলে, আই কাম ফ্রম জুলিয়াস।
–আমি জুলিয়াসের কাছ থেকে আসছি।
আমার রক্তের মধ্যে একটা শিহরন খেলে গেল। এটাই ছিল আমাদের সঙ্কেত। ওই কোড-ম্যাসেজ নিয়েই দীর্ঘদিন পূর্বে আলেকজান্ডার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু সাবধানের মার নেই। হ্যারি গোল্ড আমেরিকান। সে এফ. বি. আই, নিযুক্ত কাউন্টার-এসপায়ওনেজের এজেন্ট হতে পারে। আমি ন্যাকা সেজে বলি, তার মানে?
তার মানে আমার গাড়িতে ওঠো।
নির্জনে এসে সে অকাট্য প্রমাণ দাখিল করল। সে দীর্ঘদিন ধরে আমার পেছন পেছন ঘুরছে। রাশিয়ান গুপ্তচর সংস্থা কে. জি. বি.-র নির্দেশে। আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। ওরা আমাকে ভোলেনি। ইতিমধ্যে আমি ম্যানহাটান প্রজেক্টের অন্যতম মূল খুঁটি হয়েছি। পারমাণবিক বোমার আকার ও আয়তন আমিই কষে বার করেছি। সেটাও বোধহয় কে. জি. বি. জানে; কিন্তু লস অ্যালামসের সতর্ক প্রহরার ভেতর কিছুতেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। পারছিল না। শুধু আমার জন্যই হ্যারি গোল্ড ক্রিস্টিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে অপেক্ষা করে বসে আছে-কবে আমি ওদের ওখানে আসব।
এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। স্থির হল, চার মাস পরে সান্তা ফে-তে কাস্টিলো ব্রিজের কাছে আমি গোপন তথ্যটি হস্তান্তরিত করব। হ্যারি নিজে আসবে না। আসবে তার এজেন্ট। তারিখটা স্থির হল 6 অগাস্ট 1945, সময়-সন্ধ্যা ছয়টা দশ। কোড মেসেজ ওই একই : আই কাম ফ্রম জুলিয়াস।
তবু সাবধান হলাম আমি। আমরা দুজনে বসে কথা বলছিলাম একটি নির্জন পাব-হাউসের একান্তে। মদের বিলটা আমি দু-টুকরো করে এক টুকরো পকেটে রাখলাম। হ্যারিকে বললাম-তোমার এজেন্ট যেন এই বাকি আধখানা কাগজ আমাকে দেখায়। তাহলে নিশ্চিত বুঝতে পারব সে তোমার কাছ থেকেই আসছে। যে রিপোর্টখানা আমি তাকে দেব তার দাম বিলিয়ন ডলার। আমি একেবারে নিশ্চিন্ত হতে চাই।
–কত বড় হবে তোমার রিপোর্ট?
–অত্যন্ত ছোটো। একটি মাইক্রোফিম। থাকবে একটি পলমল সিগারেটের প্যাকেটে। মন দিয়ে শোন : তোমার এজেন্ট যেন অতি অবশ্যই একটা পলমলের ভর্তি সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার রাখে তার ডান পকেটে। আমি আমার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলব–দেশলাই আছে? সে আমার হাত থেকে প্যাকেটটা নেবে, নিজের পকেটে ঢোকাবে এবং পরমুহূর্তেই তার প্যাকেট আর লাইটার বার করবে। আমরা দুজনে দুটি সিগারেট ধরাব আর তারপর পরিবর্তিত প্যাকেটটা নিয়ে আমি ফিরে আসব।
চমৎকার পরিকল্পনা। সর্বসমক্ষেই ইচ্ছে করলে লেনদেনটা তাহলে হতে পারবে।
–তাই হওয়া ভালো। যত গোপন করতে যাবে ততই ধরা পড়ার ভয়।
–ঠিক কথা। কিন্তু আর একটা কথা। বিনিময়ে আমরা তোমাকে কী দেব?
–বিনিময়ে? না কিছু দিতে হবে না।
–তা কি হয়? জুলিয়াস সেটাও জানতে চেয়েছে।
জুলিয়াসকে বল–তারা আমাকে খুঁজে বার করেনি, আমি তাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। গরজটা তাদের নয়, আমার! ঘুষ আমি চাই না। নেব না।
-ঠিক আছে। জুলিয়াসকে বলব।
চার মাস পরে নির্দিষ্ট স্থানে জিনিসটা পৌঁছে দিলাম আমি। কী অদ্ভুত ঘটনাচক্র দেখো। ওই 6 অগাস্টেই প্রথম অ্যাটম বোমা ফাটানো হল। মদ কিনবার অছিলায় আমি চলে এলাম লস অ্যালামস থেকে সান্তা ফে-তে। মদের আসরে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের ‘অ্যালেবাই’ নাকি পাকা, এ. বি. আই.-য়ের ধারণা। মূর্খগুলো ভেবে দেখেনি, ওই মদ কিনতে যে সান্তা ফেতে গিয়েছিল তার ঘণ্টাদুয়েকের মতো অনুপস্থিতিকালের কোনো সাক্ষী নেই।