বিশ্বাস কর রোনাটা-তোমার ড্যাডি, প্রফেসর কার্ল, এর সাতে-পাঁচে নেই। তার যমজভাই আজ রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসতে চান। কেন চান, তা জানি না। তিনিও প্রফেসর কাপিৎজার সহকর্মী। নিঃসন্দেহে তার কাছ থেকেই প্রফেসর কার্ল কাপিজার শেষ সংবাদটা পেয়েছিলেন, আমার কাছে স্বীকার করেননি। প্রফেসর কার্ল-এর ধারণা এবং আর্নল্ডের দৃঢ় বিশ্বাস–সেদিন তাকেই গুলি করে মারতে চেয়েছিল সেই আততায়ী। হয়তো তাকে হ্যান্স বলে ভুল করেছিল হত্যাকারী। আবার তা নাও হতে পারে। হয়তো আমাকেই মারতে চেয়েছিল সে।
1942এ আমি প্রথম রাশিয়ান গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নিজে থেকে। কেমন করে জান? আমি সোজা চলে গিয়েছিলাম লন্ডনের রাশিয়ান এম্বাসিতে। ছদ্মবেশে। তখন আমি ব্রিটিশ অ্যাটমিক রিসার্চে নিযুক্ত। ওরা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এমন গুপ্তচর ওরা কখনও দেখেনি–যে স্বেচ্ছায় খবর দিতে আসে। বিনিময়ে যে অর্থ দাবি করে না। ওরা বললে, এর পর যেন কোনো কারণেই ওদের এম্বাসিতে না আসি। যোগাযোগ রক্ষা করত একটি ছেলে। তার আসল নামটা জানি না। ছদ্মনাম ছিল আলেকজান্ডার*। [* আসল নামটা ক্লাউস ফুকস কোনদিনই জানতে পারেননি। তার নাম ছিল দাভিনোভিচ ক্রেমার। রাশিয়ান। যুদ্ধান্তে সে রাশিয়ায় ফিরে যায়।] নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে সে হাজির হত। আমি তার হাতে তুলে দিতাম আমার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল। শুধু আমার নিজে হাতে করা এক্সপেরিমেন্টের কথাই তখন জানাতাম আমি। কারণ আমার বিবেক বলত, ওই গবেষণার ফলাফল আমার নিজস্ব সম্পত্তি। আমার মস্তিষ্ক থেকে যা বার হচ্ছে তার মালিকানা আমার নিজের। ছেলেটি আরও তথ্য জানতে চাইত। আমি জানতাম না। বলতাম, অপরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফলে আমার মালিকানা নেই। জানলেও তা আমি জানাব না:
‘রহিবে বিবেক। সে শুধু আমার। বিকাবো না তারে কভু।‘
এর পরেই একটা আঘাত পেলাম। রাশিয়ান ছোকরার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম। আঘাতটা কী জান? স্তালিন হিটলারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। অনাক্রমণাত্মক চুক্তি। আমি মরমে মরে গেলাম। স্তালিনকে কোনো দিন মহান নেতা বলে মনে হয়নি আমার। আমি বরং ছিলাম ট্রটস্কির ভক্ত। কিন্তু স্তালিন যখন রাশিয়ার একনায়ক হয়ে পড়লেন তখন বাধ্য হয়ে তাকে মেনে নিলাম। বিশ্বসাম্যের খাতিরে। হিটলারের সঙ্গে যেদিন স্তালিন চুক্তিবদ্ধ হলেন সেইদিনই ওই গুপ্তচরবৃত্তিতে ক্ষান্ত দিলাম। ওই বিবেকের নির্দেশেই।
কিন্তু ওখানে তো শেষ নয়। কালের রথচক্র আবার এক পাক ঘুরল। হিটলার আক্রমণ করে বসল সাম্যবাদের রাজ্য। যে পথ দিয়ে নেপোলিয়ন মৃত্যুর মুখে এগিয়েছিল ঠিক সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলল হিটলারের ব্রিসক্রিগ বাহিনী। মস্কো তাদের লক্ষ্য। কম্যুনিজম-এর নাভিশ্বাস উঠেছে তখন। আমার বিবেক আবার পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি স্বেচ্ছায় আবার যোগাযোগ করলাম রাশিয়ান গুপ্তচরদের সঙ্গে। সাম্যবাদের এতবড় সর্বনাশ দেখে আমি আগের চেয়েও এক পা এগিয়ে গেলাম। যেসব আবিষ্কার আমার নয় তাও জানাতে শুরু করলাম ওদের।
এর পরের পর্যায় মার্কিন মুলুকে। স্যার জন কক্ৰট, চ্যাডউইক, প্রফেসর কার্ল প্রভৃতির সঙ্গে আমারও যাওয়ার কথা উঠল। আবার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হল। আবার তদন্ত হল। কিছুই পাওয়া গেল না–একমাত্র সেই নাৎসিদের ‘মিথ্যা’ দোষারোপখানা ছাড়া। ভাগ্যে ওদের মিথ্যাবাদী বলে বদনাম ছিল। চলে গেলাম আমেরিকায়। প্রথমে শিকাগো, পরে লস অ্যালামসে। এ ছাড়াও দু-একটি কেন্দ্রে যেতে হয়েছে আমাকে। লস অ্যালামসে এসে তোমার সাক্ষাৎ পেলাম। তুমি তো অবাক আমাকে দেখে। তার চেয়েও আমি অবাক মিসেস। কার্লকে দেখে। তখনও আমি জানতাম না প্রফেসর অটো কার্ল তোমার ‘ড্যাডি’, অ্যালিসের তুমি আন্টিও নও আসলে।
***
এর পরের ইতিহাস তোমার জানা। যেটুকু জান না তা এই :
আমার দুই বোন ছিল মনে আছে? ছোটো বোন লিজা আত্মহত্যা করে। সে ছিল আর্টিস্ট। ভারি সুন্দর ছবি আঁকত সে-ওয়াটার কালার, অয়েল এবং প্যাস্টেলে। বিয়ে করেছিল একজন রাশিয়ানকে–প্রাণচঞ্চল ফুর্তিবাজ কিটোস্কিকে। হঠাৎ নাৎসিদের হাতে সে ধরা পড়ে। লিজার সহায়তায় বন্দী শিবির। থেকে শেষ পর্যন্ত কিটোস্কি পলিয়ে যায়। সীমান্ত পার হয়ে চলে যায়–চেকোস্লোভাকিয়ায়। এবার নাৎসিরা অত্যাচার শুরু করল লিজার ওপর। লিজা তখন সদ্য-জননী। ওর কোলে তার প্রথম সন্তান রবার্ট–অর্থাৎ বব। মাত্র একমাসের শিশু। তার শরীর খুব দুর্বল। উপায়ান্তরবিহীন হয়ে সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে সে বাবার ওখানে পালিয়ে আসতে চাইল।
এই সময় আর একজন কমরেড এসে লিজাকে জানিয়ে গেল প্রাগে কিটোস্কি ধরা পড়েছে। তাকে নাকি নাৎসিরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। প্রথমে চোখ উপড়ে নিয়েছিল, তারপর এক-একটি করে তার সব দাঁত তুলে ফেলে–শেষে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বেলে দেয়। লিজা পাগল হয়ে গেল শুনে। আমাদের বংশে সেই প্রথম পাগল হল। আমি তার আগে দেশ ছেড়েছি। দাদাও নিরুদ্দেশ। দিদি বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে। বাবা জেল থেকে সদ্য ছাড়া পেয়েছেন। অগত্যা বাবাকেই যেতে হল–পাগল মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। উন্মাদ মেয়েকে হাত ধরে নিয়ে আসছিলেন বাবা। কী একটা স্টেশনে সে হঠাৎ বাবার হাত ছাড়িয়ে একটা চলন্ত এঞ্জিনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবার কোলে ছিল বব–এক মাসের শিশু। বাবা কিছু করতে পারলেন না। তার চোখের সামনেই লিজার দেহটা মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেল।