জন্মদিনে বাবা আমাকে উপহার দিলেন যিসাস-এর একটা ছবি। ফ্রেমে বাঁধানো। আমার পড়বার টেবিলে সেটা রেখে দিলেন আর নিজে হাতে লিখে দিলেন সুইস বিদ্রোহী-কবি উইলিয়াম টেল এর একটি চার-লাইনের কবিতা :
চিরউন্নত বিদ্রোহী শির লোটাবে না কারও পায়ে।
তোমারেই শুধু করিব প্রণাম, অন্তরতম প্রভু!
জীবনের শেষ শোণিতবিন্দু দিয়ে যাব দেশ-ভাইয়ে
রহিবে বিবেক। সে শুধু আমার। বিকাবো না তারে কভু।
বললেন, জুলি, এটাই আমার জীবনের ব্রত। এই ব্রতে তুমিও দীক্ষা নিও।
আমি জবাব দিইনি।
পরদিন বাবা ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন যিসাসের ছবিখানি তার টেবিলের ওপর রাখা। কারণটা জানতে আমার ঘরে উঠে এলেন–দেখলেন ওই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা আমি মুছে দিয়েছি।
বাবা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন এর হেতু কী।
আমি কবিতার শেষ পংক্তিটা আবৃত্তি করলাম মাত্র।
বাবা কিন্তু রাগ করেননি। দীর্ঘসময় আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন–কিন্তু আমার মত পরিবর্তন করতে পারেননি। বিজ্ঞান যা জানতে পারেনি আমি তা কিছুতেই মানতে পারলাম না।
আমি নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় বাবা নিশ্চয় দুঃখিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন–কিন্তু জোর-জবরদস্তি করেননি। মেনে নিয়েছেন আমার যুক্তি। তিনি বলতেন, সময় হলেই প্রভু যিশু মেষশাবকের মতো তোমাকে কোলে টেনে নেবেন।
***
লাইপজিগ কলেজে ভর্তি হলাম। ওই সময়েই কার্ল মার্কস্ পড়তে শুরু করি। দাস কাপিটাল এবং এঙ্গেলস-এর ভাষ্য। এতদিনে পথের সন্ধান পেলাম। হাতে পেলাম আমার বাইবেল। আমি কম্যুনিস্ট হলাম। মনে-প্রাণে। কলেজে পার্টি-পলিটিক্সে যোগ দিয়েছি। সক্রিয় অংশ নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হেরে গেলাম আমরা। ন্যাশনাল সোসালিস্টরা ক্ষমতা দখল করল। অর্থাৎ হিটলারের নাৎসি পার্টি। 1933এ একদিন কিয়েল থেকে ট্রেনে করে বার্লিন যাচ্ছি হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলাম ওরা রাইখস্ট্যাগে আগুন দিয়েছে। কম্যুনিস্ট ছাত্রদের ধরে ধরে হত্যা করছে। তৎক্ষণাৎ কোটের হাতা থেকে আমি পার্টি-ব্যাজটা খুলে ফেললাম। কলেজে আর গেলাম না। শুরু হল আমার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। প্রথমে মাসদুয়েক জার্মানিতেই ছিলাম। পালিয়ে পালিয়ে। শুনলাম, আমাদের বাড়িতে নাৎসি ছাত্ররা চড়াও হয়েছিল। হামলা করেছে বাবার ওপর। কলেজের হস্টেলেও আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ধরা পড়লে ওরা নিশ্চয় আমাকে হত্যা করত। কিন্তু ওরা আমাকে ধরতে পারেনি। সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলাম ফ্রান্সে। পারিতে ছিলাম প্রথমে, তারপর উদ্বাস্তু হিসাবে চলে গেলাম ইংল্যান্ডে।
এর পরের অধ্যায়টা তুমি জান। আশ্রয় পেলাম একটি কোয়েকার্স পরিবারে। ওই পরিবারের একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেললাম। মেয়েটিও আমাকে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু আমি যে তার আগেই আমার জীবনের ব্রত স্থির করে ফেলেছি। বাবা ছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী, আমি বিশ্ব-সাম্যবাদের। আমার জীবনের লক্ষ্য হল হিটলারকে তাড়িয়ে আমরা, কম্যুনিস্টরা, বার্লিন দখল করব। আমার সে স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে, রোনাটা। 1945এর তিরিশে এপ্রিল সেই রাইখস্ট্যাগের ওপর কাস্তে-হাতুড়ি-আঁকা লাল পতাকাটা আমরা উড়িয়েছি।
কিন্তু এ কী জার্মানি ফেরত পেলাম আমরা? বার্লিনের মাঝামাঝি উঠল পাঁচিল। এপারেও জার্মানি ওপারেও জার্মানি–অথচ দুদিকের মানুষ আজ স্বদেশবাসী নয়। তাদের মাঝখানে আজ দুস্তর ব্যবধান।
মন্ত্রগুপ্তি জিনিসটা আছে আমার রক্তে। আমি যে সাম্যবাদের পূজারী তা ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি কেউ, আমি ইংল্যান্ড আসার পর। এখানে আমি ছিলাম ভালো ছেলে। ছাত্রানাম্ অধ্যয়নং তপঃ। দিনে আঠারো ঘন্টা বিজ্ঞান-চর্চা করেছি। সে তুমি দেখেছ। কিন্তু তুমিও জানতে পারনি আমি রাত জেগে রাজনীতির বই পড়তাম। মার্ক-এঙ্গেল-লেনিনের বাণী আমার কণ্ঠস্থ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল অনেক কম্যুনিস্ট। তাদের সঙ্গে আমি কিন্তু কোনো যোগাযোগ রাখিনি। কারণ আমি লুকিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। স্কটল্যান্ডইয়ার্ড তাই সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার সময় আমার বিরুদ্ধে কিছুই খুঁজে পায়নি। ছিল একটি মাত্র রিপোর্ট। হিটলারের গেস্টাপো-বাহিনি আমাকে ফেরত পাঠাতে বলেছিল প্রাকযুদ্ধ-যুগে। বলেছিল, আমি নাকি কম্যুনিস্ট। স্কটল্যান্ডইয়ার্ড সে রিপোর্টের ওপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করেনি কারণ নাৎসিরা তাদের বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই মিথ্যা কথা বলতো।
উদ্বাস্তু জীবনের প্রথমেই স্থির করেছিলাম, একলা চলার পথে চলব। তাই চলেছি সারাজীবন। এমন কি যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম তাকেও মন খুলে বলতে পারিনি আমার গোপন কথা। আমার জীবন উৎসর্গীকৃত। যে কোনোদিন আমি ধরা পড়ে যেতে পারি। তৎক্ষণাৎ অবধারিত মৃত্যু। তাই মেয়েটিকে গ্রহণ করতে পারিনি। তাছাড়া আরও একটি বাধা ছিল। সেটাও অনতিক্রম্য। আমরা ছিলাম বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। মেয়েটি পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী, আমি চরম নাস্তিক। মেয়েটির কাছে ধর্মই ছিল জীবনের নিউক্লিয়াস; আমার জীবনে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সই ছিল ধর্ম। তথাকথিত ধর্ম আমার কাছে আফিঙের নেশা। কেমন করে মেলাবো বলো এমন বিপরীত মেরুর বাসিন্দাদের?
অথচ কী আশ্চর্য দেখ! কী অদ্ভুত ঘটনাচক্র। সেই মেয়েটির জীবন জড়িয়ে গেল আমার সঙ্গে নিবিড়ভাবে। আমার জন্যই জীবন দিল সে। আমিও আজ জীবন দিতে বসেছি তার জন্য।