আমি অভিমান করে বলি, সে কথা আগে বললেই হত।
আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। মাকে বলি, এ মার্কে হবে না মা, কুকুরের যে লেজ নেই। দু-মুখে রাজার ছাপওয়ালা মার্ক একটা দাও।
মা তো আমার মতো পাগল নন। বললেন, অমন মার্ক হয় না বাছা। ও-লোকটা তোমাকে কুকুরছানা দেবে না, তাই এমন অদ্ভুত দাবি করছে।
আমি কিছুতেই শুনব না। ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি। শেষমেশ মা আর মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে এক ঘা মেরেই বসেন আমাকে। অভিমানে আমি সারাদিন জলস্পর্শ করি না। মা অনেক সাধ্যসাধনা করলেন, টাকশালে কীভাবে মুদ্রা ছাপা হয় বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমিও অবুঝ। সারাটা দিন প্রায়োপবেশনেই গেল।
সন্ধ্যার পর বাবা ফিরলেন। প্যাস্টর ফুকস্ নন, লেদম্যান ফুক। মায়ের বিরুদ্ধে আমার এবং আমার বিরুদ্ধে মায়ের অভিযোগ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর মাকেই ধমক দিলেন, তা তুমিও তো আচ্ছা বাপু। শুনছ কুকুরটার লেজ নেই। বাক্স খুঁজে দু-দিকে রাজার মুখওয়ালা একটা মার্ক ওকে দিলেই পারতে।
মা রাগ করে বললেন, তুমিও ওকে খেপিয়ে তুলছ! এমনিতে পাগল ছেলেটা সারাদিন খায়নি–
বাবা বাধা দিয়ে বললেন, তুমি থাম দেখি।
তারপর আমাকে বললেন, ঠিক আছে খোকা। কাল তোমাকে আমি অফিস থেকে অমন একটা মার্ক এনে দেব। চল, এবার আমরা খেয়ে নিই।
আমি সোৎসাহে বলি, তোমার অফিসে অমন দুমুখো মার্ক আছে?
–কত।
মা বাবাকে ধমক দেন, কেন নাচাচ্ছ ওকে? কাল আবার এই কাণ্ড হবে।
বাবা বললেন, সে তোমাকে ভাবতে হবে না। যাও, আমাদের দুজনের খাবার নিয়ে এস।
পরদিন সারাটা দিনমান আমি বাবার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকি। সন্ধ্যার পর তিনি ফিরতেই আমি লাফিয়ে উঠি, আমার সেই দু-মুখো মার্ক?
বাবা অন্যমনস্কের মতো পকেট থেকে একটা মার্ক নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কুড়িয়ে নিয়ে আমি একেবারে লাফিয়ে উঠি। দুদিকেই ‘হেড’, ‘টেইল’ নেই।
তখনই ছুটে বেরিয়ে গেলাম এবং মিনিট পনেরো পর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলাম বাড়িতে।
দেখি, ইতিমধ্যে মা বাবার জন্য খাবার বেড়ে দিয়েছেন। বাবা কিন্তু খেতে বসেননি। আলমারি থেকে তাঁর দোনলা বন্দুকটা নিয়ে পরিষ্কার করছেন। আমি ফিরতেই বললেন–কী হল জুলি? কাঁদছিস কেন? কুকুরছানা কই?
আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, দিল না। বললে, এটা অচল মার্ক।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বন্দুকটাও তুলে নিলেন হাতে। বললেন, আয় দেখি আমার সঙ্গে।
মা পিছন থেকে ডাকেন, কোথায় যাচ্ছ? খেয়ে যাও। ও লোকটা কুকুরছানা দেবে না, বুঝতে পারছ না?
-খাবারটা তুলে রাখ। ফিরে এসে খাব।
আমার বয়স, আগেই বলেছি, তখন ছিল মাত্র ছয় কি সাত। তবু দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পাই আজও। বাবা ছিলেন অত্যন্ত শান্ত নম্র স্বভাবের মানুষ। কোনোদিন তাকে রাগতে দেখিনি। অথচ সেদিন তাকে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম। বাবার সেই রুদ্রমূর্তির সামনে দোকানদার ভদ্রলোক একেবারে কেঁচো। বাবা বললেন, আপনি মানুষ না জানোয়ার মশাই? আমার ছেলেকে কেন। এভাবে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়েছেন? জবাব দিন?
লোকটা আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু এটা যে অচল মার্ক স্যার।
–আমিও তো তাই বলছি। এমন মার্ক হয় না জেনেও তা কেন দাবি করেছিলেন আপনি? আপনি কী চান? জার্মানির সব শিশু বড় হয়ে আপনার মতো জোচ্চোর থোক?
-আমার মতো জোচ্চোর?
–জুয়াচুরি নয়। প্রথমত, অসঙ্গত দাবি, দ্বিতীয়ত, ও তা পূরণ করার পরেও আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রাখেননি। আপনি কুকুরছানাটি একে না দিলে আমি আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো। ‘পাবলিক’ নুইসেন্স হিসাবে মাজায় দড়ি পরাবো আপনার!
ভদ্রলোক হাত দুটি জোর করে বলেন, স্যার, নিয়ে যান আপনার কুকুরছানা। ওই অচল মার্কে আর আমার প্রয়োজন নেই। আমিই বরং উল্টে আপনাকে পাঁচ মার্ক দিচ্ছি–শুধু বলে যান, অমন একটা দু-মুখো মার্ক কোথা থেকে পয়দা করলেন আপনি?
কুকুরছানা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম।
তুমি হয়তো ভাবছো এ-সব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক কাহিনি কেন শোনাচ্ছি তোমাকে। অসংলগ্ন-গল্প নয়, রোনাটা–এ কাহিনিটাও প্রাসঙ্গিক। আমি যা করেছি তা কেন করেছি বুঝতে হলে তোমাকে জানতে হবে কী ভাবে আমি গড়ে উঠেছি।
সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি কী পরিশ্রম করে দক্ষ কারিগরটি দুটি মার্ককে মাঝামাঝি মেসিনে চিরে আবার জোড়া দিয়েছিলেন। কেন? তার উদ্দেশ্য ছিল–তার সন্তান যেন জুয়াচুরি না শেখে। ছয় বছরের ছেলের কথার খেলাপ হতে দেবেন না বলে এতটা পরিশ্রম করেছেন। এইভাবেই তিনি আমার চরিত্রটা গঠন করতে চেয়েছিলেন।
***
আমার বয়স যখন তেরো, তখন বাবা কোয়েকার হলেন। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী। চার্চের অনুষ্ঠানভিত্তিক ধর্মের ভড়ং নয়, তিনি যিসাস্-এর ওই একটি বাণীকেই মূলমন্ত্র করলেন–’ল্যভ দাই নেবার। বিশ্বপ্রেম। মানবপ্রেম মন্ত্র হল তার-ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে। আমাদের বাড়ির আর সবাই রাতারাতি ধার্মিক হয়ে উঠল–কেউ আন্তরিক, কেউ বাবাকে খুশি করতে। একমাত্র ব্যতিক্রম তেরো বছরের একটি কিশোর-প্রহ্লাদকুলে দৈত্য-এই জুলিয়াস ক্লাউস ফুকস্। মনে মনে আমি নিরীশ্বরবাদী ছিলাম। মনে করতাম ধর্ম একটা ভড়ং। বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেছি তখন। যার প্রমাণ নেই তা মানি না। বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ দাও ঈশ্বর আছেন, তবেই মানবো, নচেৎ নয়। অবশ্য আমার এ মনোভাব কাউকে কখনও বলিনি। বাবা সেটা টের পেলেন আরও দু বছর পরে, আমার ষোড়শ জন্মদিনে।