–আপনি জানতেন? জানতেন, আমি আজ রাত্রে আসব?
–আজ রাত্রেই আসবেন তা জানতাম না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আসবেন তা জানতাম। এতদিনে মনস্থির করেছেন? বলবেন সব কথা খুলে?
-বলব। এখনই—
বলুন তবে।-কাগজ কলম টেনে নেয় আর্নল্ড।
–না, আপনাকে বলব না। বলব রোনাটাকে।
–রোনাটাকে!?–বিহ্বল হয়ে পড়ে আর্নল্ড।
–হ্যাঁ। একটা টেপ-রেকর্ডার বসিয়ে দিন ওই টেবিলটায়। অনেকগুলো বিল রেখে যান। আর হ্যাঁ–এক বোতল হুইস্কি। ফর হেভেনস্ সেক, আমাকে কোনোভাবে ডিসটার্ব করবেন না। বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঘণ্টা দু-তিন পরে ফিরে এসে টেপটা বাজিয়ে শুনবেন।
–অ্যাজ য়ু প্লিজ, স্যার।
আর্নল্ড তৎক্ষণাৎ যন্ত্রটা বসিয়ে দেয় ওর সামনে। হুইস্কির বোতল আর গ্লাসটা রাখে হাতের কাছে। মানবচরিত্র সে ভালোরকমই বোঝে। আন্দাজ করে, এখন এই অর্ধোন্মাদ অবস্থায় ফুকস্ যদি স্বেচ্ছায় সব কথা স্বীকার করে তবেই রহস্যটা পরিষ্কার হবে। রাত পোহালে হয়তো তার মতটাও পালটে যাবে। তখন আর কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাবে না তার।
নির্জন ঘরে তার প্রথম-প্রেমের মুখোমুখি বসল ডক্টর ক্লাউস ফুকস্। মাইকটাকে চুম্বন করল। তারপর ফিসফিস করে ডাকল, রোনাটা। রোনাটা।
.
০৮.
আমাদের বংশে কিছু পাগল আছে, জানলে রোনাটা? আমার বাবা হচ্ছেন এক নম্বর পাগল। তাকে তো তুমি ভালো রকমই চেন। তার ধারণা তিনি হচ্ছেন অ্যাটলাস-জগদ্দল এক পৃথিবীর ভার বহন করতেই তিনি এসেছেন এ দুনিয়ায়। জিয়ুস বুঝি হুকুম দিয়েছে–ওটা ঘাড়ে করে চুপচাপ বসে থাক। ব্যস। বাবা ডাইনে। তাকান না, বাঁয়ে তাকান না–জগদ্দল পৃথিবী ঘাড়ে করে বসে আছেন সারাটা জীবন। আর এক পাগল ছিল প্রমিথিয়ুস। তাকে তুমি চেন না। তার কথা থাক। এছাড়া আমার ছোটো বোন এবং মা-ও পাগল হয়েছিল। আমি কিন্তু তা-বলে পাগল নই। এ আমার আদৌ পাগলামি নয়। ধীর স্থির মস্তিষ্কে সব কথা তোমাকে জানাতে এসেছি। আমি এটুকু বুঝি–তুমি একা নয়, ওরাও এটা জানবে। তা জানুক। আজ গোটা পৃথিবীটাকে ডেকে এ কথা শোনাতে চাই–আমার কথা, তোমার কথা। ভেবে দেখলাম এ ছাড়া পথ নেই। তোমার ‘ড্যাডি’-কে না হলে ওরা মুক্তি দেবে না। এখনই তো প্রায় অন্তরীণ হয়ে আছেন, দুদিন পরে ওঁকে জেলে পুরবে। ওদের যে ধারণা হয়েছে–তিনিই সেই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক ডেক্সটার। কথাটা সত্য নয়। বিশ্বাস করো রোনাটা–কথাটা সত্য নয়। ওরা ভুল বোঝে বুঝক–কিন্তু তুমি কেমন করে বিশ্বাস করলে–তোমার ড্যাডি এতবড় পাপকাজটা করবেন?
-কী বললে? তা হলে কে সেই ডেক্সটার? আমি চিনি কি না? হ্যাঁ, আমি চিনি। না–রিচার্ড ফাইনম্যান নন, রবার্ট ওপেনহাইমার নন, প্রফেসর অটো কার্লও নন। ডেক্সটার হচ্ছে সেই হতভাগ্য যার বাহুবন্ধনে তুমি ধরা দিয়েছিলে : ডক্টর এমিল জুলিয়াস ক্লাউস ফুকস্।
-প্লিজ রোনাটা। ও-ভাবে ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিও না। আমার কথাটা শেষ পর্যন্ত শোনো। একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করি, কেমন?
***
-তুমি জান, আমার জন্ম ফ্রাঙ্কফুর্ট-এর কাছাকাছি একটা গ্রাম-রাসেলশীম-এ 1912তে। না, পঁচিশে ডিসেম্বর নয়, তার চারদিন পরে। প্রচণ্ড শীতের রাত্রে। আমরা দুই ভাই, দুই বোন। দাদা গেহার্ড, দিদি ক্রিস্টি, আমি, আর আমার ছোটো বোন লিজা। বাবা ছিলেন পাদরি–প্যাস্টর এমিল ফুকস। খ্রিস্টান ধর্মযাজক হয়েছিলেন অনেক পরে–উনিশ শ পঁচিশে; আমার বয়স তখন বছর তেরো। তার আগে তিনি ছিলেন একটি কারখানার মেশিনম্যান। লেদ আর ওয়েল্ডিং-এর দক্ষ কারিগর। সে-যুগের কথা তুমি জান না। তুমি যখন তাকে দেখেছ তখন তিনি কোয়েকার্স সম্প্রদায়ভুক্ত। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী–সোসাইটি অব ফ্রেন্ড এর একজন কর্ণধার। আমি তাকে মিস্ত্রী হিসাবেও দেখেছি।
একদিনের কথা মনে পড়ছে। তখন আমার বয়স কত হবে? এই ধর ছয়-সাত। আমরা থাকতাম ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছাকাছি একটা কারখানার বাড়িতে। দু কামরার একটা ছোট্ট বাড়িতে। সৎ ও দক্ষ কর্মী হিসাবে কারখানায় বাবার খুব সুনাম ছিল। সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধা করত। এই সময় আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোকের কুকুরের বাচ্চা হল। ভারি সুন্দর বাচ্চাগুলো। লোমে ভর্তি। আমি আর লিজা রোজ ওই কুকুরছানাগুলোকে দেখতে যেতাম। ভদ্রলোকের নামটা আজ আর মনে নেই, তবে তার চেহারাটা মনে আছে। আমাদের পাড়ার মনিহারি দোকানের মালিক, মধ্যবয়সী, মোটা, একমাথা টাক। রোজ আমাদের ভাইবোনকে কুকুরের লোভে আসতে দেখে উনি একদিন নিজে থেকেই বললেন, কী খোকা? একটা কুকুরছানা নেবে?
আমি তো লাফিয়ে উঠি? বলি, দেবেন?
–দেব। তবে বিনা-পয়সায় নয়। দাম দিতে হবে। এক মার্ক।
এক মার্ক কতটা তখনও বুঝি না। তবে বামা-মা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসেন। একটা মার্ক কি আর দেবেন না? আমি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসি। মাকে বলি, মা একটা মার্ক দেবে? ওই দোকানদার ভদ্রলোক তাহলে আমাকে একটা কুকুরছানা দেবেন বলেছেন।
মা জানতেন, কুকুরছানাটা আমার প্রাণ। তৎক্ষণাৎ এক ডয়েশমার্ক আমার হাতে দিলেন। আবার নাচতে নাচতে আমি ভদ্রলোকের কাছে ফিরে গেলাম। উনি বোধহয় আশা করেননি আমি বাড়ি থেকে একটা ডয়েশমার্ক নিয়ে আসতে পারব। আসলে কুকুরছানাটা হস্তান্তরের কোনো বাসনাই ছিল না তার। শুধু শুধু বাচ্চা পেয়ে আমাকে নাচাচ্ছিলেন। এখন কায়দা করে বললেন, এরকম মার্ক-এ তো হবে না খোকা। দেখছ না, আমার কুকুরের লেজ নেই। ডয়েশমার্কেও ‘টেইল’ থাকলে চলবে না। এমন মার্ক আনতে হবে যার দু-দিকেই হেড অর্থাৎ দুদিকেই কাইজারের মুখ ছাপা।