রাশিয়া বা চিনের কথা জানি না, কিন্তু যে ভারতবর্ষ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে বলে স্কুলে থাকতে কোরাস গান গাইতুম তার খবর কী? 1947 এ ক্টর হোমি ভাবার সভাপতিত্বে পরমাণু-শক্তি কমিশনের প্রথম সভা হয়েছিল, তারপর রিসার্চ রিয়্যাকটর ‘অপ্সরা’র উদ্বোধন হল, ‘জারলিনার’র জন্ম হল, রাজস্থানে পরমাণুকেন্দ্র স্থাপনের একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে, ট্রম্বেতেও কাজ হচ্ছে বলে জানি। আজকের সংবাদপত্রে নারোয়ায় চতুর্থ পরমাণু কেন্দ্রের শিলান্যাস হবার খবরও ছাপা হয়েছে–কিন্তু আসল কাজ কতদূর হয়েছে জানি না। যেটুকু জানি, তা হচ্ছে এই–মোমবাতির আলোয় এই কৈফিয়ৎ লিখছি!
এটুকু বুঝি যে, আজ যদি আমরা চিত্তরঞ্জনে বিদ্যুৎ-বাহিত রেলওয়ে এঞ্জিনের পরিবর্তে আবার বয়লার এঞ্জিন বানাবার চেষ্টা করি, পেট্রোল, কোলগ্যাস, কয়লা, কেরোসিন, রেড়ির তেল, কাঠ থেকে ধাপে ধাপে নামতে নামতে মা ভগবতীর অকৃপণ দানের ভরসায় বসে থাকি তবে আমাদের নাতি-নাতির’ কপালে দুঃখ আছে।
আজ তাই মনে হচ্ছে, গত পঁচিশ বছরে পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে কোনো খোঁজ-খবর না নিয়ে কাজটা ভাল করিনি। আর সেইজন্যই আপনাকে বলব–এ বইটি যদি না পড়েন তো না পড়লেন, কিন্তু আদৌ যদি পড়েন তবে পাতা বাদ দিয়ে পড়বেন না।
আপনার ‘প্রনাতির’ দোহাই!
নারায়ণ সান্যাল
13.1.74
.
আশির দশকের কৈফিয়ৎ
গ্রন্থরচনার দশ বছর পরে এই কৈফিয়ৎটি সংযোজন করা প্রয়োজন বোধ করছি। প্রথম প্রকাশকালেই গ্রন্থটি অধ্যাপক হোমি জাহাঙ্গির ভাবার পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত। দ্বিতীয় কথা, এ গ্রন্থের অটো কার্ল কাল্পনিক চরিত্র। কোনো বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই।
আর একটি কথা। বিদেশি নাম এবং বৈজ্ঞানিক শব্দ বাংলা-হরফে প্রকাশ করা খুব কঠিন; যদি লেখকের সেই ভাষাজ্ঞান বা বিশেষ-বিজ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্ট পড়াশুনা না থাকে। ফলে, প্রথম প্রকাশকালে অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিকের নাম আমি বাংলা হরফে ঠিকমতো লিখতে পারিনি। সাহা ইন্সটিট্যুটের অধ্যাপক রাজকুমার মৈত্র, (পি. আর. এস.) ও অধ্যাপক অশোক চট্টোপাধ্যায় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঞ্জন ভট্টাচার্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এইজাতীয় ত্রুটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাকে অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিও তাদের কল্যাণে এবারে সংশোধন করা গেল।
নারায়ণ সান্যাল
14.8.84
২. কে?
পনেরই সেপ্টেম্বর 1945।
অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র একমাস আগে। ইউরেনিয়াম-বোমা-বিধ্বস্ত হিরোশিমা আর প্লুটোনিয়াম-বোমা-বিধস্ত নাগাসাকির ধ্বংসস্তূপ তখনও সরানো যায়নি। জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স অথবা জাপানের অধিকাংশ জনপদ মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত। বিশ্ব এক মহাশ্মশান! মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ পৃথিবীতে এতবড় ক্ষয়ক্ষতি আর কখনও হয়নি। সেই মহাশ্মশানে শুধু শোনা যায় মিত্রপক্ষের বিজয়োল্লাসের উৎসব-ধ্বনি–যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাবসানে মাংসভুক শিবাকুলের উচ্ছ্বাস!
প্রিয়-পরিজনদের নিয়ে প্রাতরাশে বসেছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ স্টিমসন। ওয়াশিংটনের অনতিদূরে হাইহোল্ডে, তার বাড়ির ‘ডাইনিং হল’-এ। অশীতিপর ঠিক নন, হেনরি. এল. স্টিমসনের বয়স ঊনআশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ সমরসচিব সেক্রেটারি অফ ওয়্যর। এ বিশ্বযুদ্ধে ছিলেন আমেরিকার সর্বময় কর্তা। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের আমলের লোক–এই বয়সেও অবসর নেননি কর্মজীবন থেকে। নেবার সুযোগও হয়নি। তাকে এতদিন অব্যাহতি দিয়ে উঠতে পারেননি রুজভেল্টের স্থলাভিষিক্ত নতুন প্রেসিডেন্ট-হ্যারি ট্রুম্যান। অন্তত যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
তা সেই যুদ্ধ এতদিনে শেষ হল। এবার ছুটি দাবী করতে পারেন বটে স্টিমসন। বিবদমান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একমাত্র আমেরিকার ভূখণ্ডে কোনো লড়াই হয়নি ক্ষতি হয়েছেপ্রচণ্ড ক্ষতি–আর্থিক এবং জনবলে; কিন্তু আমেরিকার মাটিতে কোনো রক্তপাত ঘটেনি। এজন্য নিশ্চয় অভিনন্দন দাবী করতে পারেন যুদ্ধসচিব। শুধু তাই বা কেন? এ-যুদ্ধের যা চরম ডিভিডেন্ড–আগামী বিশ্বযুদ্ধে তুরুপের টেক্কা-সেটা খেলার শেষে রয়ে গেছে তারই আস্তিনের তলায়! এটা যে কতবড় প্রাপ্তি তা শুধু তিনিই জানেন; আর বোধকরি জানেন–মহাকাল!
হঠাৎ ঝঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। স্টিমসন মুখ তুলে তাকালেন না। ছুরি-কাটায় যেমন ছিলেন তেমনিই ব্যস্ত রইলেন। টেনে নিলেন জোড়া পোচ-এর প্লেটটা। আবার কোথাও বিজয়োৎসবের আমন্ত্রণ হবে হয়তো! এখন ওই তো দাঁড়িয়েছে একমাত্র কাজ! অর্কেস্ট্রা-নাচ-টোস্ট আর পারস্পরিক পৃষ্ঠ-কণ্ডুয়ন কমপ্লিমেন্টস্ আর কথ্রাচুলেশ। ওঁর নাতনি উঠে গিয়ে টেলিফোনটা ধরল, জানালো গৃহস্বামী প্রাতরাশে ব্যস্ত। পরমূহূর্তেই চমকে উঠল মেয়েটি। টেলিফোনের ‘কথা-মুখে’ হাত চাপা দিয়ে ফিসফিসিয়ে ওঠে : গ্র্যান্ড-পা! ইটস্ ফ্রম হিম্।
হিম! ছুরি-কাঁটা নামিয়ে রাখলেন স্টিমসন। এতে সর্বনামের সার্বজনীন ‘হিম’ নয়, এ আহ্বানে লেগে আছে হোয়াইট-হাউসের হিমশীতল স্পর্শ! টেলিফোনের সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেকখানি বৈদ্যুতিক তার–তাই পর্বর্তকেই এগিয়ে আসতে হল মহম্মদের কাছে। যুদ্ধসচিবকে আর উঠে যেতে হল না। ন্যাপকিনে মুখটা মুছে নিয়ে যন্ত্রবিবরে শুধু বললেন : স্টিমসন।