ভগলু বোধ করি রক্তের দাগটা লক্ষ্য করেনি। সে প্যাকেটটা নিয়ে চলে যায়। টলতে টলতে ফিরে আসে ভিন্সেন্ট। ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যায় দোরগোড়ায়।
গগন পরদিনই রাঁচি ছেড়ে পালায়। সুলেখা আর চিত্রলেখা যে অভিন্ন ঊর্মিলা আর মিসেস ডেভিডসন যে একই ব্যক্তি এসব তথ্য গগন আদৌ জানত কিনা জানি না কিন্তু এটুকু সে জানত ভিন্সেন্ট সুযোগ পেলেই তাকে খুন করবে!
গগনের খবর পেয়েছিলাম পরে। সে নাকি কলকাতায় ফিরে আসে। খিদিরপুরের ডক-অঞ্চলে থাকত। শেষ পর্যন্ত কোন সারেঙের ব্যবস্থাপনায় একটি বিদেশী জাহাজে খালাসী হয়ে কোন্ সুদূরে পাড়ি জমায়। গগন আর ভারতবর্ষে ফিরে আসেনি।
কিন্তু ভিন্সেন্ট? তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ডক্টর ডেভিডসন। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে আমি এবং দিল্লী থেকে সূরযভান রাঁচি এসে হাজির।
ভিন্সেন্টের যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন চোখ মেলে প্রথমেই সে দেখতে পেল ডক্টর ডেভিডসনকে। তখন সন্ধ্যা হব-হব।
-হ্যালো! ডাকল ভিন্সেন্ট।
–হ্যালো! ফিরে দাঁড়ালেন ডক্টর ডেভিডসন।
–আমি কি আপনার বাড়িতে আছি?
বাড়িতে নয়, হাসপাতালে।
–ও!
বোধহয় মনে পড়ে গেল ভিন্সেন্টের। নিজের অজ্ঞাতেই হাতটা চলে গেল কানের দিকে। ডাক্তার ওর হাতটা ধরে ফেলেন। বলেন, ওখানে হাত দেবেন না।
–ও হ্যাঁ! আমার মনে পড়ে গেছে..ওটা নেই! না?
–না থাকে ক্ষতি নেই। বাঁধাকপির পাতার মত ঐ কানটা দিয়ে তো মানুষ শোনে । আপনার শুনতে কোন অসুবিধা হবে না। দু-চার দিনেই ঘা শুকিয়ে যাবে।
আমার বন্ধু, গগন পাল! সে কোথায়?
তিনি চলে গেছেন। তার মালপত্র নিয়ে চলে গেছেন।
মিসেস ডেভিডসন? তিনি কোথায়?
–আপনি বেশি কথা বলবেন না এখন। চুপ করে শুয়ে থাকুন। অনেকটা রক্ত পড়েছে ত! আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
ভিন্সেন্ট অস্ফুটে বলে, আপনি খুব ভাল লোক ডাক্তার সাহেব!
ঘুমবার চেষ্টা করে। ঘুম আর আসে না। ডাক্তারবাবু চুপ করে বসেছিলেন একটু দূরে, একখানা চেয়ারে। ভিন্সেন্ট লক্ষ্য করে দেখে ঘরে তার খাট আর ঐ চেয়ারখানা ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। এটা নিশ্চয় হাসপাতালের কেবিন। কিন্তু কেবিনে সাধারণত যেসব জিনিস থাকে তা তো নেই! আবার বলে, –এটা কি হাসপাতালের কেবিন?
-হ্যাঁ।
–ঘরটা এত ফাঁকা কেন?
–আমি ঘর থেকে সব কিছু সরিয়ে দিয়েছি, আপনাকে বাঁচাতে।
-কার কাছ থেকে?
–আপনার নিজের কাছ থেকে।
ও!
আপনি একটু ঘুমবার চেষ্টা করুন।
এবার সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে ভিন্সেন্ট।
পরদিন সকালে যখন ওর ঘুম ভাঙল দেখে ডাক্তারবাবুর সেই চেয়ারখানায় বসে আছে সূরযভান। তার মুখটা ম্লান, ক্লান্তিতে যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখ দুটো টকটকে লাল।
-সূরয! ডাকল চন্দ্রভান।
সূরয চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে। বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দাদার হাতখানা টেনে নিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
-আশ্চর্য সূরয! যখনই তোর জন্য প্রাণ কাঁদে চোখ মেলে দেখি তুই এসেছিস! সেই জোড়-জাঙালের কথা মনে আছে সূরয?
সূরযভান মাথাটা নাড়ে। কথা বলতে পারে না।
–তুই কেমন করে খবর পেলি রে?
–গগ্যাদা টেলিগ্রাফ করেছিল।
–গগ্যার ভারি অন্যায়। মিছিমিছি তোর অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। আমি তো ভালই হয়ে গেছি।
দুজনেই কিছুটা চুপচাপ। তারপর সূরয বলে, ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ও কিছু নয়। দু-চার দিনের মধ্যেই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এবার আমি তোমাকে দিল্লী নিয়ে যাব দাদা। এভাবে একা একা তোমার থাকা চলবে না।
–বেশ তো। না হয় দিল্লীতে গিয়েই থাকব। তোর কাছে থাকলেই আমি ভাল থাকব।
একটু ইতস্তত করে সূরয বলে, –একটা খবর আছে দাদা!
-খবর! ভাল, না খারাপ?
–তোমার ভালই লাগবে নিশ্চয়!
–কী রে?
–আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।
ভিন্সেন্ট কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ তার খেয়াল হয়, কী আশ্চর্য! এমন একটা আনন্দের কথায় সে চুপচাপ আছে! খুশিয়াল হয়ে বলে, বাঃ বাঃ! খুব ভাল কথা! মেয়ে দেখেছিস? কেমন মেয়ে?
–দেখেছি বইকি! আমাদের প্রতিবেশী। ওরাও আমাদের স্বজাত। কনৌজী ব্রাহ্মণ। ওর বাবা দিল্লীতে ব্যবসা করেন। মেয়েটি লেখাপড়াও শিখেছে। হিন্দি আর ইংরাজি।— তারপর একটু হেসে বলে, বাংলা জানে না কিন্তু।
–তাতে কি? ও তুই শিখিয়ে নিবি।
সূরষের ছুটি পাওনা ছিল না। বাধ্য হয়ে পরদিন তাকে ফিরে যেতে হল। যাবার আগে বললে, তুমি গিয়ে না দাঁড়ালে তো বিয়ে হবে না! কবে যেতে পারবে বল?
–ডাক্তার সাহেব ছেড়ে দিলেই যেতে পারি।
ডাক্তারবাবু বললেন দিন পনের পরেই ভিন্সেন্ট ট্রেনে চাপতে পারবে। আর দুদিন পরেই ভিন্সেন্ট চলা-ফেরা করতে শুরু করল। হাসপাতালের বারান্দায়; ক্রমে বাগানে।
সেদিন বাগানে ধীরে ধীরে পায়চারি করছিল, ডাক্তারবাবু ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন, –আজ কেমন আছেন?
সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছি মনে হচ্ছে। ব্যাণ্ডেজটা কবে খুলছেন?
পরশুর পর দিন। আপনি এখন ইচ্ছে করলে একটু একটু ছবি আঁকতে পারেন।
ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, –ছবিও আমি পরশুর পর দিন শুরু করব, কারণ, এবার প্রথমেই আঁকব একটা সেলফ পোর্ট্রেট। কানকাট্টা সেপাই!
ডাক্তার সাহেব কাছে ঘনিয়ে এসে বললেন, বলুন তো মিস্টার গর্গ হঠাৎ কেন অমন কাণ্ডটা করলেন?
ভিন্সেন্ট অনেকক্ষণ কোন জবাব দিল না।