তৎক্ষণাৎ ভিন্সেন্টের মাথার মধ্যে টলে উঠল। একটা আর্ত চিৎকার তার কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু স্বর ফোটে না তার মুখে। ওর হাত-পা অসাড় হয়ে যায়।
ওর থেকে হাত চারেক দূরে খাটের উপর খাড়া করে রাখা আছে একটা ক্যানভাস। এইমাত্র সেটা সে নিজেই বসিয়েছে। ছবিটা সেই পূজারিণী মেয়েটির। কিন্তু সে কি তবে সেদিন দেবীমন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছিল না? মদনমন্দিরে পূজা দেবার জন্যই যৌবন বিকশিত করে সদ্যঃস্নাতার বেশে দাঁড়িয়ে ছিল? তাই কি বটুকেশ্বরের স্ত্রী নিলর্জ ভঙ্গি তে কিন্তু বটুকের স্ত্রী কোথায়? ও যে, ও যে হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। চিত্রলেখা? নাথানিয়েল নয়, বটুকেশ্বর নয়–গগন পাল তার শ্লীলতা হানি করেছে।
হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চিত্রলেখা নেই, গগন পাল নেই, কিন্তু ঐ ছবিখানা আছে। ওর সমস্ত আক্রোশ ফেটে পড়ল ঐ ছবিখানার উপর। এতক্ষণে একটা আর্ত জান্তব চিৎকার বার হয়ে এল ওর কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে। ভিন্সেন্ট লাফ দিয়ে পড়ল ক্যানভাসটার উপর। দুহাতের নখ বসিয়ে দিল ঐ নগ্নিকার নরম বুকের মাঝখানে। তারপর সে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলল ছবিখানা। দুমড়ে মুচড়ে টেনে টেনে খুলে ফেলল ফ্রেমের কাঠগুলো। পেরেকে হাত কেটে গেল। রক্ত ঝরল; কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই ভিন্সেন্টের। ওর চিৎকারে ইতিমধ্যে দ্বারের কাছে কারা যেন ছুটে এসেছে। সে-সব দেখতে পেল না ভিন্সেন্ট। বদ্ধ উন্মাদের মত সে তখন ক্যানভাসটা কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে ফেলছে। মুখ দিয়ে গাঁজলা বার হচ্ছে। তারপর সংজ্ঞা হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। জ্ঞান যখন হল, তখন দেখে সে শুয়ে আছে খাটের উপর। ভগলু আর সরযূপ্রসাদ বসে আছে পায়ের কাছে। স্থানীয় একজন ডাক্তারবাবুও আছেন। আর তার পিছনে দীর্ঘকায় গগনের মাথাটা জেগে আছে।
-গেট আউট! য়ু স্কাউণ্ড্রেল!-চিৎকার করে ওঠে ভিন্সেন্ট।
ডাক্তারবাবুর ইঙ্গিত পেয়ে মুহূর্তে গগন বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
ক্রমশ ভিন্সেন্ট সুস্থ হয়ে উঠল। ডক্টর ডেভিডসন এসে ওকে পরীক্ষা করলেন। ইনজেকশান দিয়ে গেলেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ভিন্সেন্ট।
ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন ক্রাইসিস্টা পার হয়ে গেছে। পুরো দেড়দিন ঘুমবে রোগী। তারপর সে স্বাভাবিক হয়ে জেগে উঠবে। ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী কিছুটা ফলেছিল। পুরো ছত্রিশ ঘন্টা ঘুমলো ভিন্সেন্ট। বাকি ভবিষ্যদ্বাণীটা ফলে থাকলে বলতে হবে সুস্থ মস্তিষ্কেই সে খুন করতে চেয়েছিল গগন পালকে।
শেষরাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল গগনের। খোলা জানালা দিয়ে চতুদর্শী চাঁদের আলোয় ঘরটা আলোয় আলো। গগন দেখতে পেল তার বিছানার অদূরে দাঁড়িয়ে আছে ভিন্সেন্ট। পা টিপে টিপে সে এগিয়ে আসছে ওর খাটের দিকে। ভিন্সেন্টের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ; তার চোখে খুনীর দৃষ্টি। তার হাতে একখানা খোলা ক্ষুর। ক্রপ-কোম্পানির যে ক্ষুর দিয়ে গগন রোজ দাড়ি কামায়।
চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে গগন। দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে ফেলে ভিন্সেন্টের ডান হাতখানা। গগনটা একটা অসুরভিন্সেন্টের তুলনায়। তবু আজ যেন ভিন্সেন্টের গায়ে মত্তহস্তীর বল। দুজনে জড়াজড়ি করে পড়ে মেঝের উপর। ভিন্সেন্টের হাত থেকে ক্ষুরটা ছাড়িয়ে নিতে যায় গগন-ফলে তার নিজের হাতটাই মারাত্মকভাবে কেটে যায়। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত গগন ওকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালায়।
ভিন্সেন্ট উঠে বসে। ক্ষুরে রক্তের দাগ। গগনের রক্ত।
হঠাৎ আবার নজরে পড়ে গতকাল যেখানে চিত্রলেখার ছবিখানা বসানো ছিল ঠিক সেইখানে আজ বসানো আছে আর একটি চৈলচিত্র। ঊর্মিলা ডেভিডসন। সমস্ত শরীর নয়, আবক্ষ চিত্র। পোর্ট্রেট। ছবিটা ভাল কি খারাপ সার্থক কি ব্যর্থ তা লক্ষ্যই হল না ভিন্সেন্টের। সে একনজরে দেখে নিয়েছে লাবণ্যময়ী মেয়েটির বুকের তলায় স্বাক্ষর রেখেছে ওর সহপাঠী গগন পাল। এবার আর ছবিখানা নষ্ট করল না ভিন্সেন্ট। সেটা তুলে নিল হাতে। চোখটা ঝাপসা হয়ে এল।
ছবিটাকে উদ্দেশ করে সে ডান হাতখানা বাড়িয়ে ধরে। বলে, -ঊর্মিলা, এই দেখ চিত্রলেখার প্রণয়চিহ্ন সারাজীবন আমি বয়ে বেড়াচ্ছি–তবু সে আমাকে ছেড়ে ঐ গগ্যার কাছে গেছে! তুমি যা প্রণয়চিহ্ন চেয়েছ তাও আমি তোমাকে দেব। বাকি জীবন সে চিহ্নও বয়ে বেড়াব কিন্তু কথা দাও, তুমি চিত্ৰলেখার মত বিশ্বাসঘাতকতা করবে না? বল! কথা দাও!
তারপর ও অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসে।
এক পোঁচে নিজের ডান কানটা কেটে ফেলে ক্ষুর দিয়ে।
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে! চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে জল। তবু নির্বিকার ভিন্সেন্ট। কাটা কানটা দিয়ে ঢাকা দেয় ঊর্মিলার ছবির দক্ষিণ স্তনের উপর গগন পালের ঐ স্বাক্ষরটা। হাত দিয়ে কানের ক্ষতচিহ্নটা চেপে ধরে। রক্ত বন্ধ হয় না। ধারাস্রোতে রক্ত ঝরছে। ঝরুক। ভিন্সেন্ট ঐ ছবিটার সঙ্গে কাটা কানটা দিয়ে একটা প্যাকেট জড়ায়। তারপর গগনের বিছানার চাদরটা তুলে নেয়; নিজের ক্ষতচিহ্নটার উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড পাগড়ি বাঁধে। বেরিয়ে আসে বাইরে।
ভগলু যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। তাকে ডাকল। বললে, –এই প্যাকেটটা ডাক্তার সাহেবের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। বলবি মেমসাহেবকে আমি দিয়েছি।