পরদিন সমস্ত দিন সে স্বেচ্ছাবন্দীর মত পড়ে রইল ঘরে। গগন ওর খবর নিল না। সে যে পাশের ঘরে আছে তা বোঝা যায় খুট খুট শব্দে। দিনভর কিছু খায়ওনি। বাড়া ভাত পড়ে আছে টেবিলের উপর। জানালা দিয়ে চড়ুই পাখি এসে খুঁটেছে, ছিটিয়েছে। ভিন্সেন্টের মাথার মধ্যে আবার সেই যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে।
সেরাত্রে একটা ঘুম এসেছিল ওর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বাঁশীর শব্দে। পাশের ঘরে গগন একলা বসে আড়বাঁশী বাজাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে বাইরে। স্তব্ধ রাত্রে সেই বাঁশীর মীড়-গমক যেন কোন অতীন্দ্রিয় লোকে যাত্রা করেছে। অপার্থিব কোন সুরলোকের একটা অব্যক্ত মূৰ্ছনা যেন পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ছে ক্রমাগত। ভিন্সেন্টের মনে হল এমন সুরজাল যে সৃষ্টি করতে পারে সে কেমন করে বন্ধুর ঘর ভাঙে?
এর দুদিন পরের কথা। সমস্ত দিন বাইরে বাইরে ছবি এঁকে ক্লান্ত দেহে ভিন্সেন্ট ফিরে আসছিল তার ডেরায়। গগনের সঙ্গে এখনও তার সন্ধি হয়নি। দুজনে দু ঘরে থাকে আপন মনে। ভিন্সেন্ট আউটডোব ধরেছে সারাদিনই বাইরে থাকে, ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আর গগন সারাদিন তার রূদ্ধদ্বার কক্ষে কী আঁকে তা সেই জানে, বাড়ির বাইরে যায় সন্ধ্যায়। ফিরে আসে গভীর রাত্রে টলতে টলতে। সেদিন সমস্ত দিন ছবি এঁকে ভিন্সেন্ট ফিরে আসছিল হঠাৎ গেটের কাছে তাকে রুখল ভগলু, রঘুবীরের ছেলে। তার বিচিত্র দেহাতী ভাষায় প্রশ্ন করে, মেমসাবকা সাথ ভেট ভেল কা?
-কৌন সা মেমসাব?–প্রশ্ন করে ভিন্সেন্ট।
জবাবে জানতে পারে তার সঙ্গে সাক্ষাতের মানসে আজ নিয়ে তিনদিন এক মেমসাহেব গাড়ি নিয়ে আসছেন। কোনদিন সকালে, কোনদিন বিকালে। একদিনও দেখা হয়নি। ভিন্সেন্ট আশ্চর্য হয়ে যায়। ভারি অদ্ভুত তো! এমন খবরটা ইতিপূর্বে কেউ তাকে জানায়নি! না গগন, না মালি!
ঘরে ফিরে এসে মালিকে ডেকে পাঠায়। লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে মালি সরপ্রসাদ বার হয়ে আসে তার ভোলার চালের আউট-হাউস থেকে।
-হ্যাঁরে! আমার সঙ্গে এক মেমসাহেব দেখা করতে এসেছিল?
জী হাঁ। বহু তো হর রোজ আতি হ্যায়।
কই, আমাকে বলিসনি তো?
–হামি কি বলবে? ম্যয় নে সোচা কি ৰহ তসবির বালা বাবু নে আপকো কহা থা!
সরযূর দোষ নেই। সে কেমন করে জানবে মেমসাহেব কার সন্ধানে আসে! সে স্বতঃই আন্দাজ করেছিল এক বাবু দোসরা বাবুকে যা জানাবার তা জানাবে। হঠাৎ বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে ওঠে। গগন এ-খবরটা লুকোচ্ছে কেন? ঊর্মিলা নিশ্চয়ই বলেছে সে ভিন্সেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল! একটু সন্ধান নিতে আরও সব অদ্ভুত খবর বার হয়ে পড়ে। মিসেস ডেভিডসন প্রতিদিনই আসেন এবং অনেকক্ষণ বসে যান। দুনম্বর তসবিরবাবুর সঙ্গে গল্পগুজব করেন। গতকাল নাকি ও বাবু মেমসাহেবের বাচ্চার একখানা তসবির এঁকেছে! মেমসাহেব অনেকক্ষণ ছিলেন এখানে। পেনসিলের ছবি আঁকিয়ে নিয়ে গেছেন।
ভিন্সেন্ট উন্মাদের মত পায়চারি করতে থাকে। আজ সে এর ফয়সালা করবে। সে বটুকেশ্বর নয়। সবকিছু নির্বিবাদে সয়ে যাবার মত মানুষ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ নয়। প্রয়োজন হলে সে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেবে গগনকে। বন্ধু বলে রেয়াৎ করবে না। আজ আসুক গগন! যত রাত্রিই হোক ও জেগে অপেক্ষা করবে।
অদ্ভুত যোগাযোগ! সে রাত্রে গগন ফিরল না। সমস্ত রাত বারান্দায় পায়চারি করে গেল চন্দ্রভান। প্রহরের পর প্রহর কেটে গেল। শেষকালে পুব দিকের আকাশ ফর্সা হয়ে এল, কিন্তু গগনের পাত্তা নেই। আলো ফুটতেই সে বেরিয়ে পড়ল।
হনহন করে রাস্তা পার হয়ে ডক্টর ডেভিডসনের বাসায় এসে যখন পৌঁছল তখনও ভাল করে সকাল হয়নি। বাড়ির দরজায়ান একটু অবাক হল এত সকালে ভিসিটার্স আসতে দেখে। জানালো, সাহেব মেমসাহেব দুজনের কেউ নেই। গাড়ি নিয়ে হাজারিবাগ গেছে গতকাল। সন্ধ্যায় ফিরবেন।
গাড়িতে আর কে কে আছে?
–বাচ্চারা আছে। আর লম্বা মত এক বাবু আছে। তসবিরবালা বাবু।
তসবিরবালা বাবু? তুমি কেমন করে জানলে?
ও তো মেমসাহেবের তসবির বানাচ্ছে।
আবার হনহন করে ফিরে এল বাসায়। গগন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়! ঊর্মিলার সঙ্গে সে ভাব জমিয়েছে। ভিন্সেন্টকে ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি। কে জানে ঊর্মিলা তাকে কতখানি বলেছে। এর একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ভিন্সেন্ট সুস্থ হতে পারবে না। এখনি তাকে এর শোধ নিতে হবে। আবার সে আপন মনে বিড়বিড় করে বললে, তুমি ভুল করছ গগন; আমি বটুকেশ্বর দেবনাথ নই। ঊর্মিলার ওপর কোন বাঁদরামি আমি সহ্য করব না।
পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত সে পায়চারি করছে বারান্দায়, আর মাঝে মাঝে চোখ তুলে চাইছে কখন ফিরে আসে গগন।
মনে পড়ে গেল গগন রাঁচিতে আসার আগে তাকে প্রশ্ন করেছিল ওদের মধ্যে কে বেশি ভাল ছবি আঁকে। কে বড় আর্টিস্ট ভিন্সেন্ট ভান গর্গ, না পল গগ্যা। সে সমস্যার সেদিন মীমাংসা হয়নি। আজ গগন ওর জীবনের প্রথম প্রেমকে ছিনিয়ে নিয়ে দুনিয়ার কাছে প্রমাণ রাখবে সেই বড়। কিন্তু কেমন ছবি আঁকে গগন? তার আঁকা একখানা। ছবিও সে ভিন্সেন্টকে দেখতে দেয়নি।
দুত্তোর, নিকুচি করেছে।
ভিন্সেন্ট লাফিয়ে ওঠে। কয়লা ভাঙার জন্য একটা লোহার ডাণ্ডা ছিল; সেটা নিয়ে দমাদম বাড়ি মারতে থাকে গগনের ঘরের তালাটায়। অচিরেই ওর সেই প্রচণ্ড ক্রোধের সম্মুখে হার স্বীকার করল ছোট্ট তালাটা। ঘরে ঢুকল ভিন্সেন্ট। সমস্ত ঘর অগোছালো। রঙ, তুলি, ক্যানভাস ছড়ানো। ও-পাশে থাক দিয়ে রাখা আছে গগনের আঁকা ছবি। ভিন্সেন্ট হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তুলে নেয় স্বচেয়ে বড় ক্যানভাসটা। বসিয়ে দেয় খাটের উপর। তারপর একটু দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে দেখে।