সরকার ঘোষণা করলেন ষোলোই অক্টোবর উনিশ-শ পাঁচে বাঙলা দেশকে কেটে দু খানা করা হবে। বাঙলা হিসাবে সেটা ত্রিশে আশ্বিন। অমনি দিকে দিকে এই দিনটিকে ক্ষোভ আর দুঃখের প্রতীক করে তোলার আয়োজন পূর্ণ করে তুললেন দেশের নেতৃবৃন্দ। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করলেন দুই বঙ্গের মিলনের প্রতীক হিসাবে এদিন অনুষ্ঠিত হবে রাখীবন্ধন উৎসব। রামেন্দ্রসুন্দর বললেন, ঐ সঙ্গে সারা দেশে হবে অরন্ধন। সুরেন্দ্রনাথ অখণ্ড বঙ্গভবন গড়ে তোলার প্রস্তাব করলেন। সমস্ত দেশে সে কী ভাবের জোয়ার! কোন বাঙালীর ঘরে সেদিন উনানে আগুন জ্বলে নি। ব্যবসাবাণিজ্য সব বন্ধ, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, পাল্কি অথবা গোরু-গাড়িও চলে নি। সেই প্রথম সারা দেশব্যাপী হরতাল।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল বরিশালের। বড়লাট কার্জন গোটা বরিশাল জেলাকেই প্রোক্লেমড ডিস্ট্রিক্ট বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী জেলা বলে চিহ্নিত করলেন। অশ্বিনীকুমারের স্বদেশ বান্ধব সমিতি বিলাতি জিনিসের বহ্ল্যুৎসবে মাতলো– দেশী জিনিস বিদেশী জিনিস যার দোকানে রাখা হত তাদের বয়কট করতে শেখালো। চারণকবি মুকুন্দদাস বরিশালের পথে পথে প্রাণ মাতানো গান গেয়ে বেড়ান। অশ্বিনীকুমারের সহযোগী মনোমোহন চক্রবর্তীর লেখা গানও মুকুন্দদাস গেয়েছেন–ছেড়ে দাও কাচের চুড়ি, বঙ্গনারী, কভু হাতে আর পর না! জাগ গো ভগিনী, ও জননী, মোহের ঘোরে আর থেক না।
সেবার কংগ্রেসের একবিংশতিতম অধিবেশন বসল কাশীতে। সভাপতিত্ব করলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। সভাপতির ভাষণে তিনি বললেন–বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের ফলে বঙ্গদেশের এই বিপুল জনজাগরণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করবে। ব্রিটিশ রাজত্বে এই প্রথম জাতি ও ধর্মের বৈষম্য ভুলে বাঙালী জাতি বাইরের কোন সাহায্যের অপেক্ষা না রেখে স্বাভাবিক প্রেরণার বশে অন্যায়ের প্রতিরোধে অগ্রসর হয়েছে। প্রধান লক্ষণীয় বিষয় এই যে, জনসেবার উচ্চ আদর্শ থেকে বাঙলা এ কাজ করেছে, আর সমগ্র ভারতবর্ষ এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে বাঙলা দেশের কাছে ঋণী। আজ বাঙলা যে কথা চিন্তা করছে, আগামীকাল সারা ভারতবর্ষ সে কথা চিন্তা করবে।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলন সেবার হবে বরিশালে। প্রথম সম্মেলন হয়েছিল বহরমপুরের, বৈকুণ্ঠনাথ সেনের আগ্রহাতিশয্যে। তারপর, কৃষ্ণনগর, চুঁচুড়া, চট্টগ্রাম, নাটোর, বর্ধমান প্রভৃতি স্থানেও প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছে। এ বছর স্থির হয় এপ্রিলের চোদ্দই ও পনেরই অধিবেশন বসবে বরিশালে। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যারিস্টার আবদুল রসুল হবেন সভাপতি। রসুলসাহেব মেম বিয়ে করেছিলেন; কিন্তু সেই বিদেশী মহিলাও মনে-প্রাণে সমর্থন করলেন স্বাধীনতা আন্দোলনকে। সে বৎসর বাখরগঞ্জ জেলায় ফসল ভাল হয় নি। দুর্ভিক্ষই হয়েছিল বলা চলে। তবু জেলার বিভিন্ন অংশে যখন প্রচারে বের হলেন বরিশালের নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন, সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অথবা শরকুমার রায় তখন অভূতপূর্ব সাড়া জাগল সারা জেলায়। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক সমবেত হল জেলা সদর বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজের ছেলেদেরই উৎসাহ বেশী। কলকাতা থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন দেশবরেণ্য নেতারা। ওরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে প্রচার চালায়। এই স্বদেশী আন্দোলনে ওতপ্রোত ভাবে যোগ দিয়েছিল প্রথম বার্ষিক ফার্স্ট-আর্টসের ছাত্র বটুকেশ্বর দেবনাথ।
সরকার থেকে ইতিপূর্বেই একটা সার্কুলার জারি করা হয়েছে–প্রকাশ্যে রাস্তার কেউ বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারবে না। অনেকে এ আদেশ মানতে স্বতঃই রাজী হল না। বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে গিয়ে অসংখ্য যুবক বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত হল। সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির কর্মকর্তারা জেলা-শাসকের কাছে এই সর্তে আবদ্ধ হলেন যে, প্রতিনিধিদের অভ্যর্থনা করার সময় প্রকাশ্য স্থলে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি করা হবে না। ফলে সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই একটা দলাদলির সৃষ্টি হল। চরমপন্থীরা কর্মকর্তাদের এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হল। যাইহোক সম্মেলনের আগের দিন সন্ধ্যায় কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু প্রতিনিধি বরিশালের স্টিমার ঘাটে এসে উপস্থিত হলেন। সুরেন বাঁড়ুজ্জে, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদাঁ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বটুকেশ্বর স্টিমার ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখল। চোখ ফেটে জল এল তার। এমন মহা মহা অতিথিরা এলেন তার মাতৃভূমিতে অথচ বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া গেল না। উপায় নেই। স্বয়ং অশ্বিনীকুমার বারণ করে রেখেছিলেন। অশ্বিনীকুমার ছিলেন ব্রজমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ-ক্ষেত্রে কিন্তু অশ্বিনীকুমারের সঙ্গে বর্তমান অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ একমত হতে পারেন নি। তবু নেতৃত্বের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন নি তিনি। তাঁর ছাত্ররা তাই মুখ বুজে মেনে নিলেন ওঁদের আদেশ।
স্টিমার থেকে নেমে এসে এ বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন তুললেন কৃষ্ণকুমার মিত্রঃ ছেলেরা বন্দেমাতরম্ বলছে না কেন?
রজনীকান্ত হেসে বললেন–ছেলেরা গোরা চাবুককে অগ্রাহ্য করতে শিখেছে, কিন্তু দলপতির আদেশকে অমান্য করতে শেখে নি বলে!