দাদু উদ্দেশে কাকে যেন প্রণাম করলেন যুক্ত করে। অস্ফুটে বললেন-বড় খাঁটি কথা। উনসে বড়া, উনসে বিশাল ঔর ক্যা হ্যায়?
০৩-৪. বটুকেশ্বর দেবনাথ
বটুকেশ্বর দেবনাথের কথাটাই আগে বলি। চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সে-ই পেয়েছিল আর্টস্কুলের ছাড়পত্র। কেতাদুরস্ত আর্টিস্ট হয়েছিল বরিশালের ছেলে বটুকেশ্বর। পূর্বভারতের সবচেয়ে বড় তিনটি নদী– পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, আর মেঘনা যেখানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে মিশেছে সেই বদ্বীপে বরিশাল নদীর পশ্চিমতীরে এই বরিশাল। নদীমাতৃক ভূখণ্ড যেমন উর্বর, ওখানকার মানুষগুলোও তেমনি দুর্বার। জোয়ারের সময় মেঘনার মুখে প্রবল বান আসে তখন প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসে এক কামান গর্জনের মত গুরুগম্ভীর শব্দ। ইংরেজরা তার নাম দেয় বরিশাল গানস। তিন-চার শ বছর আগে থেকেই মগ জলদস্যুরা এদেশে মাঝে মাঝে লুণ্ঠন করে যেত। ব্রহ্মরাজ যখন আরাকান দেশ আক্রমণ করেন তখন অনেক মগ এই জেলায় পালিয়ে আসে। এখানেই তারা স্থায়ী বাস্তু বাঁধে। পুরুষানুক্রমে এই জেলাতেই থেকে যায়। ধর্মে এরা ছিল বৌদ্ধ। অনেকেই হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে অবশ্য। বটুকেশ্বরের পদবী ছিল দেবনাথ; বোধকরি তার পূর্বপুরুষ এক কালে ছিল নাথ-পন্থী বৌদ্ধ। সে ইতিহাস বটুকেশ্বর জানত না; কিন্তু এটুকু জানত যে তার রক্তের মধ্যে আছে মেঘনার পথে ছুটে আসা বঙ্গোপসাগরের রোষ; ঐ বরিশাল গানস।
বটুকের বাবা দীননাথ দেবনাথ ছিলেন ছাঁ-পোষা ভালমানুষ। বরিশাল স্টিমার ঘাটে গঞ্জের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে তাঁর ছিল পাটোয়ারি গুদাম আর ব্যবসা। ছেঁচা বাঁশের বেড়া দেওয়া দেওয়াল আর টালির ছাদ। দীননাথ লেখাপড়া শেখেন নি বেশি, শিখেছেন শুভঙ্করীর হিসাব, যা তাঁর কাজে লাগে পাটোয়ারী ব্যবসায়ে। কিন্তু ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন। ওঁদের পাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলো সব বখাটে আর বদমায়েস। তাই শহর কলকাতাতে রেখেছিলেন বটুককে, তার মামা বাড়িতে। ওর মামা ইংরাজ কুঠিয়ালের মুচ্ছুদ্দি। করিৎকর্মা লোক। ভাগ্নেকে মানুষ করে তোলার ভরসা দিয়েছিলেন বলেই দীননাথ বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন।
কিন্তু লেখাপড়া শিখতে বসেও বটুক মনে শান্তি পায় না। ইংরাজি, অঙ্ক অথবা ইতিহাস-ভূগোলে সে মনোনিবেশ করতে পারে না। তার সখ সে ছবি আঁকবে। বরিশালের গ্রামে আসন্ন বর্ষার যে পট সে দেখেছে শিশুকালে, মেঘনার বুকে প্রকৃতির যে ভীমসূন্দর রূপ দেখেছে ভাদ্রের সাঁড়াসাড়ি বানে, সেটাকে সে রঙে আর রেখায় ধরতে চায়। ম্যাট্রিক পাস করে তাই সে বায়না ধরল আর্টস্কুলে ভর্তি হবে। এবার কিন্তু দীননাথ রাজী হতে পারেন না। ছবি আঁকা কেউ আবার পয়সা দিয়ে শেখে নাকি? ছবি এঁকে কোন্ চতুর্বর্গ লাভ হবে? ছেলেকে আর কলকাতায় ফিরতে দিলেন না। নিয়ে এলেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি করে দিতে।
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ তখন স্বনামধন্য রজনীকান্ত গুহ। সব কথা শুনে তিনি বলেন, দীননাথবাবু, আপনার পুত্রকে যদি আমার কলেজে ভর্তি করে দেন তাহলে তার দায়িত্ব আমি নিতে পারি, কিন্তু সে ক্ষেত্রে জলপানির টাকা কিন্তু বটুকেশ্বর পাবে না।
-কেন? পাবে না কেন? প্রশ্ন করেছিলেন দীননাথ দেবনাথ।
স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার ফরমান জারি করেছেন যে, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলে কোন ছাত্র সরকারী বৃত্তি পাবে না।
ব্যামফিল্ড ফুলার কে? জিজ্ঞাসা করেছিলেন বরিশালের পাটোয়ারী দেবনাথ।
ফুলারের নাম শোনেন নি? তিনি নবগঠিত পূর্ববঙ্গ আর আসামের ছোটলাট। ডন ম্যাগাজিনে দেখেন নি, তিনি প্রকাশ্যে বহু স্থানে বলে বেড়িয়েছেন, তার দুই স্ত্রী–হিন্দু স্ত্রী দুয়োরাণী আর মুসলমান বিবি হচ্ছেন সুয়োরানী। এখানকার বানরিপাড়ায় গুর্খা সৈন্যদের কাণ্ড শোনেন নি?
দীননাথ তাঁর মাথাটা নেড়ে জানিয়েছিলেন তিনি কিছুই জানেন না।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল রজনীকান্তের। এতবড় কাণ্ডটা ঘটে গেল সদর বরিশালের বুকের উপর, অথচ এখানকার একজন বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী তার কোন খোঁজ রাখেন না। এ দেশকে জাগাবেন সুরেন্দ্রনাথ আর অশ্বিনীকুমার।
বটুকেশ্বর উপস্থিত ছিল সেখানে। ভর্তি হয়ে এসেছিল। বললে–আমি জানি স্যার! বরিশালের বিদ্রোহ দমন করতে ফুলার এখানে গুর্খা সৈন্য মোতায়েন করেছিল। আমাদের মা-বোনেদের উপর তারা অকথ্য অত্যাচার করে–
রজনীকান্ত বলেন–তুমি জান? তুমি কেমন করে জানলে?
জানি স্যার! এও শুনেছি আমার বয়সী একদল ছেলে তাই ফুলারকে হত্যা করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। সুরেন্দ্রনাথই নাকি–
–থাক বটুকেশ্বর! ওসব কথা প্রকাশ্যে আলোচনা করতে নেই।
বটুকেশ্বর চুপ করে যায়। রজনীকান্ত তখন দীননাথকে বলেন–আপনি যদি জলপানির মায়াটা ত্যাগ করেন তাহলে আমি একে ভর্তি করে নিতে পারি।
চকিতে ওঁর মনে হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ আর অশ্বিনীকুমার তো দিবাস্বপ্ন দেখছেন না। প্রৌঢ় ব্যবসায়ী দীননাথ খবর রাখে না এটাই তো একমাত্র সংবাদ নয়; তার নাবালক পুত্র সবই খবর রাখে এটাও তো সত্য!
আগুন জ্বলছে। এ আগুন নিভবে না।
বটুকেশ্বর ভর্তি হল ব্রজমোহন কলেজে।
কিন্তু টিকতে পারে নি সেখানে; ফিরে এসেছিল কলকাতায়। কেন তা বলিঃ