চন্দ্রভান মুখ নিচু করে অপরাধীর মত বসে থাকে।
হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে ওর ছোট ভাই সূরযভান।
সন্ন্যাসী রাগ করে না। সেও অট্টহাস্য করে ওঠে। বলে সাধ মেটে নি এখনও? পাগল, বুদ্ধু কাহাকা!
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। এমন পাগলের সঙ্গে দেখা করতে এত পরিশ্রম করে এসেছি? একা চন্দ্রভান কেন, আমরা সবাই তো পাগল!
বটুকেশ্বর কিন্তু আশা ছাড়ে নি। বলে–ওটা একেবারে বদ্ধ পাগল, বাবা। ওর কথা বাদ দিন। এবার আমার কথা বলুন। আমি পাস করতে পারব এ বছর?
সন্ন্যাসী মাছি তাড়াবার মুদ্রা করেন। বলেন-তোর কিছু হবে না, সরস্বতী মাইয়ের কৃপা তোর উপর হবে না। যা ভাগ!
বটুকের মুখটা ম্লান হয়ে যায়। বলে,–পাস করতে পারব না বাবা?
সন্ন্যাসী ততক্ষণে তার বড় ছিলিমে আর একটা অন্তিম টান দিয়ে ধোঁয়া গিলে বসে আছেন। মুখের উপর বিরক্তিকর মাছি বসলে লোকে যেভাবে হাত নেড়ে তাড়ায় সেইভাবে বিরক্তি প্রকাশ করলেন শুধু। আমার কিছুমাত্র বিশ্বাস হয় নি। শুধু মজা দেখতে ইচ্ছে হল। নিজের কথাটা সঙ্কোচে বলতে পারলুম না। গগনকে বলি–এই গগ্যা, বাবাকে হাতটা দেখা না; তোকে নিয়েই ভয়। আয়, কাছে আয়–
গগনটা চিরকালই ডাকাবুকো। সে যে এসব বুজরুকির ভিতর নেই এটা প্রমাণ করতে রীতিমত তফাতে দাঁড়িয়েছিল ততক্ষণ। সেখান থেকে ইংরাজীতে একটা জ্ঞানগর্ভ বাণী ঝাড়ল। ম্যাট্রিকে চার্লস ল্যাম্বের সেক্সপীয়র আমাদের পাঠ্য ছিল। ম্যাকবেথ-এর একটা প্যাসেজ ছিল মোস্ট ইম্পর্টেন্ট কোশ্চেন। আমরা মাত্র একবার ম্যাট্রিক দিয়েছি; কিন্তু বার কয়েক ম্যাট্রিক দিয়ে অমন ইম্পর্টেন্ট কোশ্চেনগুলো গগনের একেবারে ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল। ও শুনিয়ে দিল, ডাইনীদের ভবিষ্যত্বাণী শুনে ব্যাঙ্কোর সেই অনবদ্য উক্তিটি, ম্যাকেবেথের প্রতি। ব্যাঙ্কো বলেছিল–এরা ছোটখাট ব্যাপারে আমাদের কিছু সত্যিকথা বলে বিশ্বাস উৎপাদন করে। তারপর ভরাডুবি করায়। গগন সেই লাইনটা আউড়ে গেল গম্ভীর কণ্ঠে—“These ministers of darkness tell us truth in little things, to betray us into deeds of greatest consequence.”
সাধুবাবার ততক্ষণে তন্দ্রা এসে গেছে। কম্বলের বিছানায় তিনি লম্বা হয়ে পড়েছেন। শয়নে পদ্মনাভ–চোখ দুটি আরামে বোজা। ইংরাজী শুনে তাঁর চমক ভাঙল। গঞ্জিকাপ্রসাদে সে চোখ দুটি টকটকে লাল। যেন ভস্ম করে ফেলবে গগ্যাকে। গগ্যা ভস্ম হল না। সেও কটমট করে তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই সাধুবাবা এমন একটা কাণ্ড করে বসলেন যা স্বপ্নেও আশঙ্কা করি নি তাঁর কাছ থেকে। সাধুবাবা বললেন বাৎ তো ঠিক হ্যায় বেটা! লেকিন ম্যাকবেথ সিওয়া উহ্নোনে হ্যামলেটভি লিখিন থা! না ক্যা রে? নেহি শুনা হ্যায় তু ও “There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy?”
আমরা বজ্রাহত। লেংটিসার ভস্মমাখা জটাধারী বাবার ইংরাজী উচ্চারণ আমাদের থার্ড মাস্টার মহেন্দ্রবাবুর চেয়ে ভাল!
গগন স্তম্ভিত হয়ে এগিয়ে আসে। ঠোঁট দুটি কেঁপে যায় তার। অস্ফুটে বলে– বাবা?
সাধুবাবা ততক্ষণে পুরোপুরি পদ্মনাভ বনেছেন। যোগনিদ্রা আসন্ন। বিড়বিড় করে কোনক্রমে বলেন–হো গা রে বেটা! তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই! তেরা বিগড়ি বনৎ বনি যাই!
তার মানে কি?
আমি দাদুকে প্রশ্ন করেছিলাম সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল? গগনবিহারী পাস করেছিলেন সে বছর?
দাদু বলেন–না, গগন পাস করতে পারে নি। আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সেই ফেল করেছিল। আমি এবং বটুক জলপানি পেয়েছিলাম, চন্দ্রভান মোটামুটি পাস করে। আর গগন আবার ফেল! আমার অবশ্য পাস করে গভর্ণমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া হয় নি। বাবা আমাকে জোর করে ভর্তি করে দিলেন প্রেসিডেন্সিতে–ফার্স্ট আর্টস পড়তে। বটুক চলে গেল বরিশালে, তার বাপের কাছে। ভর্তি হল ব্রজমোহন কলেজে। যদিও সে সেখানে টিকতে পারে নি। বছরখানেকের মধ্যেই আবার সেখান থেকে পালিয়ে আসে কলকাতায়। এবার ভর্তি হয় সরকারী আর্ট কলেজে। অবনীন্দ্রনাথ তখন আর্ট কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল। আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র বটুকেশ্বরই আর্টস্কুলের শিক্ষা শেষ করেছিল। সেই হয়েছিল পাস করা আর্টিস্ট। আমি ডাক্তার। চন্দ্রভান আর গগন তাদের জীবনে কোন প্রতিষ্ঠা পায় নি।
আমি বলি তাহলে সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী আর ফলল কোথায়?
দাদু বলেন–সেই গল্পই তো শোনাতে বসেছি। ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রীর ভবিষ্যদ্বানী বর্ণে বর্ণে ফলে গিয়েছিল।
আমি চমকে উঠে বলি কী নাম বললেন সন্ন্যাসীর? ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রী? কী আশ্চর্য! এঁর কথা যে আমি বাবার কাছে শুনেছি।
দাদু বলেন–তা তো হতেই পারে। তোমার বাবা তো শিবপুর কলেজ থেকে এঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন আঠারশ আটানব্বইয়ে। কলেজের পাশেই তো ঐ কোম্পানির বাগান। তা কি বলেছিলেন তোমার বাবা?
আমি বলি– তিনি বাবাকে বলেছিলেন দিনান্তে অন্তত একবার নির্জনে গিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবে, তাহলে নিজেকে চিনতে পারবে। প্রকৃতির কোন বিরাট মহৎ প্রকাশের সামনে যখন দাঁড়াই তখন আত্মার বিরাটত্ব উপলব্ধি করতে পারি। ধ্যানস্তিমিত পর্বতশ্রেণী, গহন অরণ্য, বিশাল সমুদ্র, এরা মানুষের মনের আগল সরিয়ে দেয়। সেই অর্গলমুক্ত মনের ভূমা স্পর্শ পাওয়া যায়। বাবা তখন সন্ন্যাসীকে প্রশ্ন করেছিলেন সংসারী মানুষ আমরা, দিনান্তে অমন অরণ্য-পর্বত-সমুদ্রের সাক্ষাৎ পাব কেমন করে? উত্তরে ধ্রুবানন্দ নাকি বলেছিলেন–উপর দেখতে রহো বেটা, ইসলিয়ে বহ্ তুমকো দে চুকা এক বিশাল নীলাকাশ! ইনসে বড়া, ইনসে বিশাল ঔর ক্যায় হ্যায়?