হঠাৎ বটুক বলে ওঠে-এই, এই দ্যাখ! সাধুবাবার ধ্যান ভেঙেছে।
তাই তো! সাধুবাবা উঠে পড়েছে। আমাদের দেওয়া একটা আম খাচ্ছে বসে। দাড়ি বেয়ে নেমেছে আমের রস! আমরা তৎক্ষণাৎ পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে গুটিগুটি এগিয়ে যাই সেদিক পানে। বটুকেশ্বর আমাদের দলপতি। সকালে আমাদের সাড়ম্বর প্রণামটা সাধুবাবার আধবোজা চোখজোড়া দেখতে পেয়েছিল কিনা মালুম নেই-তাই বটুক আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। আমরাও দেখাদেখি ঘাসের উপর লম্বা হয়ে পড়লাম। শুধু গগন হাত তুলে জাত বাঁচানো আলতো একটা নমস্কার ঠুকে দেয়। সাধুবাবা খুশি হয়েছেন মনে হল। মিষ্টি মিষ্টি হাসছিলেন তিনি। দক্ষিণ হস্তটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই বাম হস্তটি প্রসারিত করে বললেন–জিতা রহো বেটা! ক্যা মাংতা রে?
দেখতে হাঁদা মত হলে কি হয়, বটুক তুখড় ছেলে। হাত দুটি কচলে বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে–আপনার দর্শন পেয়েছি। আর কি চাইব বাবা?
সাধুবাবা একটি চিনির মঠ ভেঙে নিদন্ত মাড়িতে সেটি চর্বনের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন; বলেন–সচ? বাঃ বাঃ! অব তো দর্শন হো গয়া। অব ভাগ!
বটুক হাত দুটি জোড় করে বলে–আজ্ঞে হ্যাঁ, যাব তো বটেই; তবে এসে যখন পড়েছি বাবা, তখন আপনার শ্রীমুখ থেকে দু-একটি বাণী শুনে যেতে চাই।
সন্ন্যাসী চিমটিখানা তুলে নিয়ে পুনরুক্তি করেন–যা ভাগ!
চন্দ্রভান ছিল একটু পিছনে। সেখান থেকে বলে ওঠে–চলে আয় বটুক!
সন্ন্যাসী এতক্ষণে নজর করেন ওকে। হঠাৎ ভ্রূ-যুগল কুঁচকে ওঠে ওঁর। চিমটেটা নামিয়ে রাখেন। ইঙ্গিতে চন্দ্রভানকে কাছে আসতে বলেন। চন্দ্রভান এগিয়ে যায়। বসে ওঁর সামনে হাঁটু মুড়ে। কোন কথা নেই। সন্ন্যাসী স্থির দৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন চন্দ্রভানের ভূ-মধ্যে। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ খপ করে ওর চুলের মুঠিটা খামচে ধরে বলেন-ক্যা নাম?
–শ্রীচন্দ্রভান গর্গ!
জনম তারিখ মালুম?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ঊনত্রিশে জুলাই, আঠারশ নব্বই!
সাহব বন্ গয়্যা ক্যা? চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকি দেন সাধুবাবা।
চন্দ্রভান তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলে-সাতই শ্রাবণ, বারোশ সাতানব্বই।
–তো শিবলোক ইয়ে বৈকুণ্ঠ পসন্দ নেহি হুয়ে? ক্যা রে বেটা?
মাথা মুণ্ড কিছু বোঝা যায় না। চন্দ্রভান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
চুলের মুঠিটা এতক্ষণে ছেড়ে দিয়ে ওকে এক ধাক্কা মেরে সাধুবাবা বলেন–ভাগ। যবন কাহাকা।
চন্দ্রভান পালিয়ে বাঁচে।
কিন্তু বটুকেশ্বর অত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। ইতিমধ্যে আর একটি আমের খোসা ছাড়িয়ে বাবাজীর ভোগের জন্য বাড়িয়ে ধরেছে। কাকের মত ছোঁ মেরে সেটি তুলে নেন বাবাজী। দু-চোখ বুজে ভূতো-বোম্বাই আম চুষতে থাকেন। আম এবং দাড়ির কিছু অংশ।
বটুক বলে–ও যবন নয় বাবা। বামুন! কনৌজী ব্রাহ্মণ!
বিলকুল যবন! তব শুন্!
সন্ন্যাসী অতঃপর ওঁদের এক বিচিত্র কাহিনী শোনান।
দ্বৈপায়ন-দাদু বলতে থাকেন–যাট-সত্তর বছর আগেকার কথা নরেন, তবু গল্পটা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। তার কারণ সে সময়ে অপরিণত কৈশোরের অবিশ্বাসে গল্পটা যতই আষাঢ়ে মনে হোক না কেন, পরবর্তী জীবনে বারে বারে মনে হয়েছে অদ্ভুত দিব্যদৃষ্টি ছিল সেই সন্ন্যাসীর। জীবনে তাকে ঐ একবারই দেখেছি সেই উনিশ-শ পাঁচ সালের এপ্রিল মাসে; কিন্তু তাঁকে ভুলতে পারি নি সারা জীবনে।
আমি জিজ্ঞাসা করি কী গল্প বলেছিলেন সাধুবাবা?
–গল্প নয়। চন্দ্রভানের জন্মান্তরের কাহিনী বলেছিলেন। শুনেছি, সাধনার এক পর্যায়ে সাধক পূর্বনিবাসজ্ঞান লাভ করেন। তখন তিনি জাতিস্মর হয়ে ওঠেন। পূর্বজন্মে কবে কি করেছেন তা বলে দিতে পারেন। বুদ্ধদেব ঐ দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন–যার ফলশ্রুতি জাতকের অনবদ্য কাহিনীগুলি। কিন্তু এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী তাঁর নিজের পূর্বজীবনের কথা তো বলেন নি। বলেছেন চন্দ্রভানের পূর্বজন্মের কাহিনী। কেমন করে বললেন? উনি ওঁর ভাঙা ভাঙা ব্রজবুলিতে যা বললেন তার নির্গলিতার্থ হল–চন্দ্রভান পূর্বজন্মে ছিল যবন। খ্রীষ্টান। কিন্তু খ্রীষ্টান হলে কি হয়, সে ছিল পুণ্যাত্মা লোক। জ্ঞানতঃ পাপ কাজ কিছু সে করে নি। তাই তার মৃত্যুর পর শিবলোক আর বৈকুণ্ঠলোক থেকে দেবদূতেরা তাকে নিতে এল। সীনটা কল্পনা কর নরেন– সাহেব চন্দ্রভানের কোটপ্যান্ট পরা পূর্বজন্মের মৃতদেহ অসাড় হয়ে পড়ে আছে আর দুইদল দেবদূত ঝগড়া করছে। একদল ওকে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাবে, একদল নিয়ে যাবে শিবলোকে। সে ঝগড়া আর থামেই না। শেষে স্বয়ং যমরাজ মীমাংসা করতে সেখানে হাজির হলেন। যমরাজ বলেন, তোমাদের ঝগড়া থামাও! এই যবনের আত্মা কোথায় যেতে চায় তা জেনে নাও। সে যদি বৈকুণ্ঠে যেতে চায়, তবে ওর অক্ষয় বৈকুণ্ঠ লাভ হবে। আর যদি ও শিবলোকে যেতে চায়, তবে তাই হবে। তখন সদ্যমৃত সেই যবনের আত্মাকে জিজ্ঞাসা করল ওরা–সে কোথায় যেতে চায়। ইতিমধ্যে সাধুবাবা গঞ্জিকার কলকেটি হাতে নিয়েছিলেন। তাতে প্রচণ্ড এক টান মেরে তিনি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন–আর ও বেটা এমন বে-অকুফ, ব্যাটা বললে, সে আবার এই পৃথিবীতে জন্মাতে চায়! এই দুনিয়ায় ওর সারা বদনে গর্দা ফেঁকেছে, ওকে পাঁকের মধ্যে পেড়ে ফেলেছে, লাথ মেরেছে–তবু ওটা এমন পাগল, এমন বে-সরম, বে-অকুফ-ও বললে এই দুনিয়াদারীর পাঁকের মধ্যেই ও ফিরে আসতে চায়। কীরে বেটা বুদ্ধ! তাই বলিস নি?