তারপর আবার একটু চুপ করে থেকে বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল আর্টিস্ট হব। গভর্ণমেন্ট আর্টস স্কুলে ভর্তি হব। হলাম গিয়ে ডাক্তার!
-আর্টিস্ট হলেন না কেন?
-বাবা হতে দিলেন না। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ। ডাক্তারী পড়তে পাঠালেন আমাকে। বাবা যে যুক্তি দেখিয়েছিলেন সেটাই ইংরাজি করে বলেছেন হারীন্দ্রনাথ :
‘Doctor’s fees are heavy, lawyer’s fees are high,
Artists are just supposd to entertain and die!’
আবার একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলেন, আচ্ছা তুমি চন্দ্রভান গর্গের নাম শুনেছ? কিম্বা গগনবিহারী পালের?
বললাম, আজ্ঞে না। কে তাঁরা?
সে কথার জবাব না দিয়ে পুনরায় বলেন, অথবা বটুকেশ্বর দেবনাথের?
এবার বলি, হ্যাঁ। বটুকেশ্বর দেবনাথ সে-আমলের একজন নামকরা চিত্রকর। রবি বর্মার স্টাইলে ছবি আঁকতেন তিনি। বেশ জোরালো ড্রইং ছিল তার।
বৃদ্ধ ম্লান হেসে আমার কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন শুধু-নামকরা চিত্রকর! না? বেশ জোরালো ড্রইং! অথচ চন্দ্রভান আর গগনবিহারীর নামই শোননি তুমি।
আবার পেশ করতে হল একই প্রশ্ন, ওঁরা দুজন কে? ছবি আঁকতেন?
বৃদ্ধ যেন নিজের চিন্তাতেই ডুবে রইলেন অনেকক্ষণ। চোখদুটি আধবোজা। হাতদুটি কোলের ওপর জড়ো করে রাখা আছে। ক্যাম্বিসের ইজি-চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উনি যেন অনেক অনেকদিন আগে ফেলে-আসা পথের বাঁকে বাঁকে পাক খাচ্ছেন। তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলেন, ওরা তিনজনই আমার সহপাঠী। ঐ চন্দ্রভান, গগন আর বটুক। একই স্কুলে পড়তাম আমরা। চারজনের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। ওর ভেতর আমি আর বটুক ছবি আঁকতাম। চন্দ্রভান আর গগন ছবি আঁকার ধারে কাছেও ছিল না। অথচ–
আবার হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। আমি নিশ্চুপ অপেক্ষা করি। খানিক পরে হঠাৎ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, তুমি তো লিখতে পার। চন্দ্রাভান আর গগনের কথাটা লিখবে নরেন? দল বেঁধে যারা ‘ফুচকো’ খেতে চায় তাদের জন্যে তো অনেক কিছুই লিখছে–যারা ক্ষীর হজম করার ক্ষমতা নিয়ে নিরস্তু উপবাস করত তাদের কথাও কিছু বল না?
বুঝতে পারি একটা গল্পের প্লট এসে গেছে হাতের কাছে। কথা-সাহিত্যের যাঁরা বেসাতি করেন তাঁদের কাছে এ জাতীয় প্রস্তাবে উৎসাহিত হওয়ার কিছু থাকে না। অধিকাংশ মানুষই ভাবে তার জীবনে আছে উপন্যাসের উপাদান, ভাল একটা রোমান্টিক কাহিনীর হিরো হবার জন্যেই সে এসেছে পৃথিবীতে। তাই এ-জাতীয় কথায় কথাসাহিত্যিক কান দেন না। জানেন, কিছুটা সময় নষ্ট করা ছাড়া এতে লাভ নেই কিছু। কিন্তু এক্ষেত্রে বক্তা তার নিজের কথা বলতে চাইছেন না; তাছাড়া বক্তা এখানে রাম শ্যাম-যদু নয় স্বয়ং ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ী।
আমি এককথায় রাজী হয়ে যাই।
দাদু বলেন, ভাল হত জীবনী লিখতে পারলে কিন্তু ওদের গোটা জীবনটা তো আমি জানি না। যেটুকু জেনেছি তাও অসম্পূর্ণ। অনেক কার্যকরণ সম্পর্ক জানা নেই আমার। তবু ওদের সম্বন্ধে বোধকরি একমাত্র আমার স্মৃতিতেই বেঁচে আছে কিছু তথ্য। আমার সঙ্গে সঙ্গে তাও শেষ হয়ে যাবে। না–আমি কোন কিছুই সাজেস্ট করব না। তুমি ওদের জীবনী লিখতে পার, ওদের কাহিনী দিয়ে নাটক লিখতে পার, বা উপন্যাস লিখতে পার। সে দায়িত্ব তোমার। তবে যা হোক কিছু লিখ ওদের নিয়ে। চন্দ্রভান গর্গ আর গগনবিহারী পালের নাম বাঙালীর জানা উচিত।
আমি বলি, জীবনী কেউ পড়ে না, নাটক লিখলে সেটা মঞ্চস্থ করার হাঙ্গামা আছে। নাটকও কেউ পড়ে না। যদি বলেন, তাহলে একটা উপন্যাসই লিখব দাদু, তবে একটা শর্ত আছে!
কৌতুক উপচে পড়ে দ্বৈপায়ন-দাদুর মোটা ফ্রেমের চশমা ভেদ করে–শর্ত? কী শর্ত?
-আপনাকে একটা ভূমিকা লিখে দিতে হবে।
হো হো করে হেসে ওঠেন দাদু। বলেন, এই কথা? কিন্তু তাহলে আমিও একটি শর্ত আরোপ করব। কঠিন শর্ত!
এবার আমাকে গম্ভীর হতে হয়। বলি, বলুন!
রোজ সকালে উঠে তোমাকে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হবে–হেই ভগবান, বইটা ছাপা হওয়া পর্যন্ত যেন বুড়ো দ্বৈপায়ন-দাদু টিকে থাকে!
আমি তৎক্ষণাৎ বলি, এ প্রার্থনা মঞ্জুর হলে ভগবানকে আচ্ছা জব্দ করা যাবে। কারণ সে-ক্ষেত্রে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটা আর কিছুতেই লিখব না আমি। দ্বৈপায়ন-দাদু অমর হয়ে থাকবেন।
অট্টহাস্যে ঘর ফাটিয়ে ফেলেন দাদু, এটা বড় জবর বলেছ হে।
সে হাসিটা আজও কানে বাজছে। কারণ এ বই ছাপাখানা থেকে বার হয়ে আসার আগেই দ্বৈপায়ন-দাদু আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছেন।
তাই তাঁর ভূমিকাটা আর যোগ করা গেল না।
.
০২.
অবশেষে চার বন্ধু রাজী হল। দেখাই যাক না পরখ করে, ক্ষতি তো নেই। আপত্তি ছিল গগনের। ও এসব বুজুরুকিতে বিশ্বাস করে না। একেবারে মূর্তিমান কালাপাহাড়। দেব-দ্বিজ-হাঁচি-টিকটিকি-মাদুলি-কবচ সব কিছুকেই সে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চায়। তা হোক, সেও রাজী হয়েছে সঙ্গে যেতে। আর কিছু নয়, সারাদিন একসঙ্গে হৈ-হৈ তো করা যাবে। পারানি-নৌকায় গঙ্গা পার হওয়া, কোম্পানির বাগানে বেড়ানো, তাই বা মন্দ কি? তাছাড়া দেখাই যাক না ভণ্ড সাধুর বুজরুকির পরিমাণ।
রবিবার ছুটির দিন। সকালবেলা বাবুঘাটের খেয়াঘাটে গুটিগুটি এসে জমায়েত হয়েছে ওরা চার বন্ধু। খবরটা প্রথমে এনেছিল বটুকটুকেশ্বর দেবনাথ। বরিশালের বাঙাল। সে খবর এনেছে যে, গঙ্গার ওপারে কোম্পানির বাগানে কে এক ত্রিকালজ্ঞ সাধু এসেছেন। প্রকাণ্ড বটগাছটার তলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন প্রায় এক মাস। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারেন। কখনও হস্তরেখা বিচার করে, কখনও স্রেফ তার কপালের দিকে তাকিয়ে। এমন ত্রিকালজ্ঞ অবধূত হাতের কাছে থাকতে তিন-তিনটে মাস অপেক্ষা করার কি দরকার? চল সবাই মিলে ওপারে যাই। বাবার পা জড়িয়ে ধরি; তাহলেই তিনি বলে দেবেন, চারজনের মধ্যে কে জলপানি পাবে, কে স্রেফ পাস করবে আর কে গাড্ডু খাবে। আর্য মিশন স্কুলের চার বন্ধু প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে ওরা। পাস না ফেল– এ জল্পনার শেষ নেই। দীপু তো রোজ প্রশ্নপত্রগুলি নিয়ে বসে আর প্রশ্নে কত নম্বর পাবে তা আন্দাজে লিখে যোগ করে দেখে। পাস করলে সে সোজা গিয়ে ভর্তি হবে সাহেব-পাড়ার সরকারী আর্টস্কুলে। আর্টিস্ট হতে হবে তাকে। বশ্যা বাঙাল বটুকেশ্বর কথা দিয়ে রেখেছে–সেও লেজুড় ধরবে দীপুর। চন্দ্রভান জমিদারের ছেলে–বাপের মস্ত জমিদারী। ন’দে-মুর্শিদাবাদে হাজার হাজার বিঘে জমির মালিক ওরা। তিনপুরুষ বসে খেলেও সে সম্পত্তি শেষ হবে না। রোজগার তাকে কোনদিনই করতে হবে না। তবে সখের পড়াশুনা কতদিন চালাবে বলা যায় না। আর গগন পাল? ও ডাকাতটা দেহেই বেড়েছে শুধু বুদ্ধিটা বাড়েনি। বয়সে সে ওদের তিনজনের চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের বড়। দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে, তবু এখনও ম্যাট্রিকটা পাস করতে পারল না।