ভিন্সেন্ট বলে, -না। আমি বারণ করে দিয়েছি।
ব্যবস্থাটা ভাল লাগে নি তার। তাকে জানিয়ে ব্যবস্থাটা করা হয় নি আদপে। ও শুধু লক্ষ্য করে দেখেছিল, গীর্জার সামনে বসেছিল একজন দেহজীবিনী শ্রেণীর সাঁওতাল মেয়ে, বাতাসী। নিটোল স্বাস্থ্য, ইঙ্গিতময় হাসি, মাথার খোঁপায় গোঁজা ফুল। এক ধামা মুড়ি আর এক ঠোঙা কদমা নিয়ে বসে ছিল। যারা বক্তৃতা শুনতে এসেছে তাদের প্রত্যেককে এক কুনকে মুড়ি আর দুটো করে কদমা বিলিয়েছে। প্রাপক জোয়ান বয়সের মরদ হলে উপরি পাওনা মিষ্টি হাসি বা কটাক্ষ। ভিন্সেন্টের এ ব্যবস্থা একেবারেই ভাল লাগে নি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ব্যবস্থাটা খোদ নাথানিয়াল সাহেবের। সে আপত্তি জানিয়েছে। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা যেন না করা হয়, এটাই তার অনুরোধ। মুড়ি-কদমার লোভে ওরা উপাসনায় যোগ দিক, এটা সে চায় না।
মাতাল আনি পুনরায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, বড় জবর বক্তিমে হয়েল ফাদারদা। আমি কিশ্যু বুঝি নাই। তা হোক! বক্তিমে যারে বলে, –এক্কেরে ফাস্টু কেলাশ!
যোসেফ বলে, আমি কিন্তুক ল্যায্য কথাটো বুলব ফাদারদা। মোর ভাল লাগেক নাই।
ভিন্সেন্ট অবাক হয়ে বলে, –ভাল লাগে নি? তাই নাকি? কেন?
যোসেফ ইয়াকুবের দিকে ভাড়টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, –টুক অমর্ত দাও কেনে য়াকুব ভাই। কালিমার্কা—
চন্দ্রভানের দিকে ফিরে বলে–লিখাপড়া শিখি নাই ফাদারদা; কিন্তুক মনে লাগে– বাতটো তুমি ঠিক বুল নাই! উঁহু! কিতাবটো পড়লে বুলতে পারতম! বাতটো বেবাক ভুল হই গেছে!
চন্দ্রভান কৌতূহলী হয়ে বলে, –কোন কথাটা তোমার মনে লাগে নি যোসেফ?
আরে হুই যে তুমি বললে না, জীবনভর কষ্ট করি যা, এ কষ্ট কষ্ট লয়, মরণের পর তুরা বেহেস্তে যাবি-ই বাতটো উ কিতাবে লিখে নাই। মরণের বাতটো কেনে লিখবে? মরণ কি সোজা! না কি বুলছ ওস্তাদ?
প্রশ্নটা এককড়িকে। সে একটা বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত ছিল। বলে, –আবার আমারে কেন সালিশ মানো বড়ভাই? আমি শালা হিঁদুর ছেলে, বাইবেল পড়েছি নাকি? তায় তুমার ফাদারদা কাল কি বুলিছে তাও তো আমি শুনি নাই
যোসেফ বলে, –মোদের ওস্তাদ বড় এলেমদার মানুষ বটে। আচ্ছা অরেই শুনাও কেনে বিত্তান্তটো! লও ওস্তাদ, শুন্যা মোরে বুঝাই দাও।
এককড়িও ভিন্সেন্টের দিকে ফিরে বলে, –বিত্তান্তটা কি?
মোমবাতিজ্বলা গীর্জায় দাঁড়িয়ে যে কথা অত লোকের সামনে কাল বলেছিল, আজ এই ইয়াকুব মিঞার ভাটিখানায় একদল মাতাল শ্রোতার সামনে সে কথাটা উচ্চারণ করতে কেমন যেন সঙ্কোচ হল ভিন্সেন্টের। কিন্তু সঙ্কোচকে সে জোর করে ঝেড়ে ফেলে। ফাদার শারদাঁর মন্ত্রশিষ্য সে। ও জানে গীর্জার পাদপীঠের চেয়ে এই ক্লেদাক্ত ভাটিখানাতেই মথীকথিত সুসমাচারের বেশী প্রয়োজন। ভিন্সেন্ট বলে, কাল আমি বলেছিলাম, এই পৃথিবীটা আমাদের সত্যিকারের ডেরা নয়, আমরা এখানে দুদিনের জন্য মুসাফিরের মত এসেছি। মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের পৈতৃক বাস্তুভিটায় ফিরে যাব–সেটা হচ্ছে স্বর্গরাজ্য। প্রভু যীশু বলেছেন, সুখের চেয়ে দুঃখই বড়, কারণ দুনিয়াদারির সুখ আমাদের শুধু দুঃখই এনে দেয়। পরমপিতাকে যে চিনেছে তার কাছে। দুঃখটা বড় কথা নয়। সে দুঃখকে জয় করবেই; কারণ সে জানে মৃত্যুর পরে আমরা সেই অনন্ত স্বর্গে ফিরে যাব। তাই বলেছিলাম-Father, we pray Thee to Keep us from evil. Give us neither poverty nor riches, but feed us with bread approprite to us.
যোসেফ ভক্তিভরে মদের ভাঁড়টা নামিয়ে রাখে। চোখ দুটো বুজে যায়। গম্ভীরভাবে বুকে একটা ক্রুশচিহ্ন এঁকে বলে, -আমিন!
তারপর চোখ খুলে তাকায়। ভাঁড়টা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে বলে, ইঞ্জিরিটা কিশশু বুঝি নাই। তবু হলপ করি বুলব, ফাদারদা ইটো এক্কেরে ছেঁদো বাত! বিলকুল ভুল!
এককড়ি প্রশ্ন করে, ইঞ্জিরি লব্জটার মানে কি দাঁড়াল?
ভিন্সেন্ট অনুবাদ করে, –হে পরমপিতা, শয়তানের হাত থেকে আমাদের তুমি বাঁচাও। আমাদের হা-ভাতে করে রেখ না, আমরা সোনাদানাও চাই না। দু-বেলা দুমুঠা খেতে পেলেই আমরা খুশি।
শ্রীরামপুর চার্চের অনুমোদিত অনুবাদ নয়, তবু ভিন্সেন্টের মনে হল এ ভাষায় অনুবাদ হলেই ওরা বুঝবে। বুঝলেও ওরা। এককড়ি জোর দিয়ে বলে, –এর ভিতরে ছেঁদো কথা কুনটো বড়ভাই। এ তো সাচ্চা কথা। দু-বেলা দুমুঠো খাতি পেলি আর কি চাই?
আন্টুনি পুনরুক্তি করে, -হক কথা। ল্যায্য কথা। এক্কেরে ফাস্ট কেলাশ।
যোসেফ তাকে প্রচণ্ড ধমক দেয়, তু চুপ যা কেনে!
ওস্তাদের দিকে ফিরে বলে, উ বাত লয়। পরথম বাতটো আমারে বুঝাও। আমি বুলছি, হেই ভগবান, আমারে শয়তানের হাত থিকে বাঁচাও; শয়তানও বুলতিছে আমারে যোসেফের হাত থিকে বাঁচাও। এখন ভগবান কি করবে আমারে বুঝাও। সে তো আমারও ভগমান, শয়তানেরও ভগমান। লয়?
কঠিন প্রশ্ন! ভিন্সেন্ট জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার আগেই এককড়ি বলে ওঠে, তুমার ঐ স্বৰ্গৰ্টা দেখি নাই ফাদারদা, তয় নরকটারে হাড়ে হাড়ে চিনি। চাও তো তুমাকেও দেখাই দিতি পারি। দেখবে পাতালরাজ্যটা?
ভিন্সেন্ট তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যায়। কয়লাকুঠির মূলকেন্দ্র হচ্ছে ঐ পাতালরাজ। ওটাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে এখানকার জীবনচক্র–ঐ পিট-হেডগিয়ারের আবর্তন ছন্দে। ওটার সঙ্গে এখনও তার পরিচয় হয়নি।