–আরে ফাদারদা যে? কুথা চলিছেন গ ইদিক পানে?
চন্দ্রভান এগিয়ে আসে। বলে,-ধাওড়ায় গিয়েছিলাম যোসেফ, তোমাদের খোঁজে। তা দেখলাম তোমরা কেউ নেই। তোমার স্ত্রী বললেন, সাঁঝের বেলা মরদরা কি আর ঘরে থাকে? দেখেন তালাশ করে ইয়াকুবের উখানে; সিখানে না দেখতি পেলি–
সঙ্কোচে থেমে পড়ে চন্দ্রভান।
ঠা ঠা করে হাসল যোসেফ। বললে,–বাতটো খতম করেন কেনে ফাদারদা? সে মাগী বলে নাই–সিখানে না দেখতি পেলি ছুকরি পাড়ায় তালাশ লিবেন?
ঐ রকমই একটা বক্র ইঙ্গিত করেছিল বটে যোসেফ মুর্মুর ধর্মপত্নী। ইয়াকুব একটা বাবুই ঘাসে বোনা জলচৌকি বাড়িয়ে দেয়। চন্দ্রভান বসে।
যোসেফের নেশা হয় নি। ক-পাঁট গিলেছে তার হিসেব নেই। নেশা আজকাল ওর হয় না। ইয়াকুব বড় জল মেশাচ্ছে ইদানীং। না হলে তিন ভাঁড় কালিমার্কায় নেশা লাগে না? বলে,না ফাদারদা, যোসেফরে ও-পাড়ায় পাবেননি। দিন ভোর গাঁইতা হাতে লড়াই করি, সাঁঝের বেলা ইয়াকুব-দোস্তের অমর্ত খাই আর রাতভোর পড়ি থাকি কিষ্টোর মায়েরে আঁকড়ে। ব্যস্! বে-লাইনে যোসেফরে দেখবেননি কখনও।
হা-হা করে ঠারে ঠারে হেসে ওঠে কয়লা কালো ভূতটা। কিষ্টো হচ্ছে যোসেফ তনয়। কৃষ্ণ নয়, কিষ্টোফার-এর অপভ্রংশ।
মাতাল আন্টুনি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়,হক কথা, ল্যায্য কথা! যোসেফ ভাই রে বেলাইনে পাবেন লাই। ও-শালা ধাম্মিক! মরলে ও-শালা সগগে যাবে!
অ্যাইও!–চিৎকার করে ওঠে যোসেফ মুর্মু। বলে, –খবদ্দার আনি! মরণ কাঁড়বি না কিন্তুক! মরণ কেনে রে? মরণ অত সোজা, লয়?
মৃত্যুর কথায় যোসেফের ঘোর আপত্তি। মৃত্যুকে সে মানে না। তামাম কুলি ধাওড়ায় সে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। উনিশশ সাত সালের কয়লাকুঠি। মেয়ে-মদ্দ বুড়ো বাচ্ছা সবাই নামে খাদে। বয়সের বাধা নেই। মেয়ে-পুরুষে ফারাক নেই। আট-ন বছর বয়স হলেই শুরু হাতে কালি। কি মেয়ে, কি মদ্দ। অবশ্য বুড়ো মানুষ তুমি দেখবে না কয়লাকুঠির ত্রিসীমানায়। ঐ শিশু বয়স থেকেই কয়লার রেণু পাকাপাকিভাবে বাসা বাঁধে ওদের ফুসফুঁসে। বিশ বাইশ-পঁচিশ যতদিন তাগদ আছে লড়ে যাও। মাদল বাজাও, পচাই খাও, নাচো গাও ফুর্তি কর। তারপর? শুরু হয় খুক খুক কাশি, ঘুস ঘুস জ্বর, হাপরের মত বুকটা ওঠে নামে। কফের সঙ্গে দু-এক ফোঁটা রক্তের ছিটে। ব্যস! তারপর হাজরির খাতায় একটা লম্বা ঢেরা। আসে একটা নতুন মানুষ, উঠতি জোয়ান– নাম লেখায় খাতায়। বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলে লাগায় প্রথম কালির ছোপ। কালিমালিপ্ত জীবনের প্রথম হাতে কালি। খাজাঞ্চিবাবু খুশি হয়। নয়া ভর্তি মানেই কিঞ্চিৎ নগদ নজরানা। বাঁধা ব্যবস্থা। এভাবেই জোড়-জাঙ্গাল কয়লাকুঠি জাবর কেটে চলেছে চিরটাকাল। এখানে এলে খনা বোধহয় নতুন করে হিসাব কষতেন–নরাগজার হিসাবটা পালটে লিখতেন–মালকাটার বয়সের ঊর্ধ্বসীমা হচ্ছে দুকুড়ি। এ-হেন কয়লাকুঠি আইনের মূর্তিমান প্রতিবাদ–যোসেফ মুর্মু। কালো কষ্টিপাথরে কোঁদা মানুষটা আড়াইকুড়ি পাড়ি দিয়েছে। একটা পা একবার জখম হয়েছে কয়লার চাঙড় ভেঙে পড়ায়; একটু খুঁড়িয়ে চলে তাই। কপালে প্রকাণ্ড একটা কাটা দাগ। খাদভসকার খাঁচার পাটাতন খুলে একবার সাতজন মালাকাটর সঙ্গে আছড়ে পড়েছিল পিটের চাতালে। একমাত্র সেই বেঁচে ফিরেছিল। মৃত্যুকে তাই জয় করেছে মুর্মু। খাদের দৈত্যটা নানান অস্ত্র নিয়ে বারে বারে আক্রমণ করেছে তাকে আগুনের বেড়াজালে আটকাতে চেয়েছে, বিষাক্ত গ্যাসে বধ করতে চেয়েছে, কয়লার চাঙড়ে সমাধিস্থূপ রচনা করতে চেয়েছে কিন্তু হার মানে নি যোসেফ মুর্মু। একখানা গাঁইতা সম্বল করে সে আশৈশব লড়াই করে গেছে। মৃত্যুকে সে তাই মানে না। তাই জোর ধমক দেয় আন্টুনিকে, -মরণ কাঁড়বি না কিন্তুক! মরণ কেনে রে! মরণ অত সোজা, লয়?
এককড়ি ওদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলে, –আপনিই লোতুন পাদরি সাহেব বটেন, লয়? কাল গীর্জা ঘরে বক্তিমে করিছেন?
চন্দ্রভান বলে, -না ভাই, আমি পাদ্রী নই–
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোসেফ বলে, উনি হলেন গে ফাদারদা!
বস্তুত গতকাল রবিবার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ তার জীবনের প্রথম সামন দিয়েছে। লোক মন্দ হয় নি। কাঠের বেঞ্চিগুলো সবই প্রায় ভেঙে গেছে। সেগুলিকে হটিয়ে মাটিতেই বসার ব্যবস্থা করেছিল। শুধু পিছনের দিকে দুটি কাঠের বেঞ্চি। তা অনেকেই এসেছিল প্রথম দিন। শুধু খ্রীষ্টান নয়-সাঁওতাল, বাগদি ভূঁইহাররাও। দু-চারজন ভদ্দরলোক বাবুমশাইও এসেছিলেন বৈচিত্রের সন্ধানে। কয়লাকুঠির জীবন বড় একঘেয়ে। নমাসে ছমাসে আসে যাযাবর বেদেবেদিনীর দল। নাচ দেখায়, ভানুমতীর খেল দেখায়। কদাচিৎ আসে বাঁদরনাচওয়ালা। গীর্জায় অনেক অনেকদিন পর বাতি জ্বলতে দেখে তাই অনেক কৌতূহলী জীব সমবেত হয়েছিল প্রথম রবিবারে। সবচেয়ে অবাক করা খবর–স্বয়ং নাথানিয়াল সাহেব এসেছিলেন ওর সামন শুনতে। বসেছিলেন সামনের একখানা চেয়ার দখল করে। সেটাও নিয়ে এসেছিল তাঁর খিদমদগার। তা সেই প্রথম দিনের সামনের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে জানবার উদ্দেশ্য নিয়েই চন্দ্রভান বেরিয়েছে এখন। বললে, কাল আমার বক্তৃতা কেমন লাগল বল?
মাতাল আর্টুনি বলে, এক্কেরে ফাস্টু কেলাশ!
বুধন বলে, হর রোব্বারেই উয়ারা মুড়িকদমা বিলাইবে নাকি ফাদারদা?