আপত্তি করেছিল আন্নাকালি। বলেছিল–ঘরে তোমার সোমত্ত মেয়ে, আমি দেখভাল করনে লারি, এমন একটা উটকো জোয়ান মানুষ
মুখ ভেঙচে জবাব দিয়েছিল পাঁচু,আরে থও বাপু! চ্যাতরা তো আর চিরটাকাল দাঁড়ে বসে থাকবে না? ও এমনিতেই একদিন উড়বে। ওড়ে উড়ুক! ভাগনির বে দিল না বলে কেউ তো আর দুষবে না!
চন্দ্রভান অবশ্য স্বকর্ণে এ আলাপচারি শোনে নি।
রোজ সে এসে বসে বাইরের দাওয়ায়। চ্যাতরা কলাই করা থালায় ভাত বেড়ে নিয়ে আসে। ভাতের মধ্যেই মুরাম-পিটের গর্তের মত ছিদ্র করে ঢেলে দেয় দু-হাতা ডাল। সঙ্গে থাকে ধোঁধল কিংবা মেটে-আলুর তরকারি, কখনও বা পুঁইয়ের ডাঁটা, মুখি কচুর তরকারি, কিংবা কুমড়ো সিদ্ধ। চন্দ্রভান মুখ নিচু করে খেয়ে যায় লাল চালের ভাত। মুখ তুলে পরিবশেনকারিণীকে দেখে নি কোনদিন। আহারান্তে পাতকুয়োর জলে মুখ-হাত ধুয়ে নেয়। এঁটো থালাটা মেজে রোয়াকের ওপরে কাত করে রেখে দেয়। হাত দিয়ে এঁটো জায়গাটা মুছেও নেয়। খ্রীষ্টানের সকড়ি না হলে ফেলবে কে?
একদিন মেয়েটি নিজে থেকেই হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার ভাতে কম পড়ে না তো?
–উঁ?–মুখ তুলে তাকায় চন্দ্রভান।
বছর পনের-ষোলো বয়স। একটু বাড়ন্ত গড়ন। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, পিঠ ছাপিয়ে পড়েছে। গায়ের রঙটি কালো। তা কালো হোক–মেয়েটি সুশ্রী। নাকটা টিকালো, চিবুকটা নিখুঁত। বন্য হরিণীর মত কাজলকালো দুটি চোখের দৃষ্টি।
না, কম পড়ে না। আমি অল্পই খাই।
–মাছ-মাংস হয় না আমাদের বাড়িতে। আপনার নিশ্চয় খুব অসুবিধা হয়।
পঞ্চানন বৈষ্ণব বলে কি এ বাড়িতে মাছ আসে না? কর্তার নাম শৈব, গিন্নির নাম শাক্ত, যত গোঁসাইগিরি কি কেবল খাওয়ার পাতে? না কি এটা ওর মিতব্যয়িতার আয়োজনে? জমিদারের বাড়ির আদুরে গোপাল এককালে আমিষ ছাড়া এক গ্রাস ভাত মুখে দিতে পারত না। চন্দ্রভান মাথা নেড়ে বললে, পেট ভরানো নিয়ে কথা।
মেয়েটি কী কথা বলতে গিয়েও বলল না। চন্দ্রভান বলে,–এতদিন আসছি, কিন্তু আপনার ভাল নামটাই জানি না।
মেয়েটি মুখ টিপে হাসে। হাসলে ওর গালে দিব্যি টোল পড়ে তোর বললে,— ভাল নাম জানেন না, অর্থাৎ খারাপ নামটা জানেন। সেটা কী?
–আপনার মামীমা সেদিন আপনাকে ছ্যাতরা বলে ডাকছিলেন মনে হল।
–হ্যাঁ, ঐটাই আমার নাম। ছ্যাতরা নয়, চ্যাতরা।
ভাল নাম নিশ্চয় একটা আছে। সেটা কী?
–এককালে আমার নাম ছিল চিত্রলেখা। এখন সেটা নিজেই ভুলে গেছি।
তখনও চন্দ্রভান মেয়েটির গোটা ইতিহাসটা জানত না। চিত্রলেখা-চিত্ৰা–চ্যাতরায় কিভাবে রূপান্তরিত হল। সেটা জেনেছিল অনেক পরে। চিত্রলেখার বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার। মেয়েকে রীতিমত স্কুলে পড়িয়ে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। দুর্ঘটনাটা না ঘটলে এ বছর সে এন্ট্রাস পরীক্ষা দিত। ঐ দুর্ঘটনাটাই চিত্রলেখাকে চ্যাতরা করেছে। দামোদরের বন্যায় এক রাত্রে ভেসে গিয়েছিল ওর বাপ-মা, ছোটভাই। ও যে কেমন করে বেঁচে গেল তা সে আজও ভেবে পায় না। মেয়েটি বললে,আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।
–তা ডাকব, তবে চ্যাতরা নয়, চিত্রলেখা বলে ডাকব।
–আমি কি বলে ডাকব আপনাকে?
—আমার নাম শ্রী–
হঠাৎ থেমে পড়ে চন্দ্রভান। এখনও শ্ৰী? আশৈশবের অভ্যাসবশে পৈতৃক নামটাই বলতে যাচ্ছিল, ভুলে গিয়েছিল তার নামের বি-শ্রী পরিবর্তনের কথা। কিন্তু কথাটা তাকে শেষ করতে হল না। চিত্রলেখা বলে ওঠে,আপনার নাম আমি জানি। আমিও কিন্তু সে নামে ডাকব না। আমি ঐ মালকাটাদের দেওয়া নামেই ডাকব আপনাকে–ফাদারদা।
চন্দ্রভান দৃঢ় আপত্তি জানায়। বলে,–ওরা অশিক্ষিত মানুষ; কিন্তু আপনি কেন এ ভুল করবেন? আমি পাদ্রী নই, ফাদার নই। তাছাড়া ফাদার হলে কেউ দাদা হতে পারে?
চিত্রলেখা খিল খিল করে হেসে ওঠে ওর অসহায় ভঙ্গি দেখে।
চ্যাতরা! ওর খাওয়া হয়েছে? অত হাসি কিসের বাপু? কালই তোর মামাকে বলব–এসব–ছেনালিপনা চলবেনি আমার বাড়িতে।
চিত্রলেখা তাড়াতাড়ি ঢুকে যায় ভিতরে। চন্দ্রভানও মরমে মরে যায়।
.
সান্ধ্য আড্ডাটা বসেছিল ইয়াকুব মিঞার ভাঁটিখানার সামনে। পৌষ মাস পড়েছে। অথচ এখনও শীতটা তেমন জাঁকিয়ে নামে নি। তা হলেও খোলা মাঠের মাঝখানে সন্ধ্যার পর থেকে হিমেল হাওয়ায় একটা কাঁপুনি ধরে। খাদের নিচে সারাটা দিনমান উলঙ্গ মানুষগুলো উত্তাপে ঝলসাতে থাকে, দরদর করে ঘাম ঝরে তখন; তারপর খাদ ভসকার খাঁচা বেয়ে সাঁই সাঁই করে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে হঠাৎ হিমেল সন্ধ্যার । মর্ত্যলোকে উঠে এলে কার না হাড়ে কাঁপন জাগে? সারাটা দিন ওরা যে সর্বাঙ্গে রেণু রেণু কয়লার পাউডার মেখেছে এখন কি ঠাণ্ডা জলে তাই ধুতে বসবে? ক্ষেপেছ? কয়লার আস্তর–ও তো অঙ্গের ভূষণ! কর্ণের সহজাত কবচকুণ্ডলের মত ছয়-সাত বছর বয়সে ঐ ভূষণ অঙ্গে চড়ে, নামে চিতায় চড়লে। ভিখু বলে-সাবুন কি হে, গাইতা চালালেও এ শালার কয়লা গা থিকে ছাড়বেনি! ওরা বড় জোর হাত দুটি ধুয়ে ফেলে, ভিজে হাতটা বুলিয়ে নেয় মুখে-চোখে। তা সেদিন সাঁঝ-বেলায় ঐ রকম। কালিমাখা একসার মানুষ বসেছিল ইয়াকুবের ভাটিখানার সামনে। আগুনের চারপাশ ঘিরে।
শাল আর অর্জুন গাছে ছাওয়া নিরালা পরিবেশ। বস্তী থেকে কিছুটা দূরে, নামালের দিকে। সিঙারণের খাদের ধারে ইয়াকুব মিঞার চোলাই মদের ভাটিখানা। পাশেই একটা তেলেভাজার দোকান। সাতবাসি-ছোলা-ভাজা, কলাই-সিদ্ধ, প্যাঁজি, ফুলুরি সাজানো আছে একটা কাঠের বারকোশে। নগদ পয়সা ফেললেই শালপাতার ঠোঙায় চাট হিসেবে পাওয়া যায়। সন্ধ্যাবেলাটা ইয়াকুবের মরবার সময় নেই। মাটির ভাঁড়ে ক্রমাগত সরবরাহ করে যেতে হয় অমৃতরস-পচাই, ধেনো, মহুয়ারস, কালিমার্কা।— আজও ওরা গুটি গুটি এসে বসেছে। তিন নম্বরের ভিখন, বুধন, যোসেফ, ঈশাক। আন্টুনির বেশ নেশা হয়েছে। মাথাটা দোলাচ্ছে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে কি বকে চলেছে। এসেছে ওভারম্যান এককড়ি সরখেল। মালকাটার দলে মিশে মদের আসর জমাতে তার আপত্তি নেই। ওর পদমর্যাদার স্বাতন্ত্র্যবোধটা বোধহয় পাতাল রাজ্যের অতলেই সীমাবদ্ধ-উপরের এই নীল আকাশের নিচে মালকাটার যে দুঃখ, ওভারম্যানের তাই। একহারা মানুষ, মজবুত গড়ন। কিন্তু ভিতরটা বিলকুল ফোঁপড়া। হবে না? পাতালরাজ্যেই যে সে বিকিয়ে দিয়ে এসেছে জীবনের শেষ শক্তিটুকু। নবছর বয়সে ঢুকেছিল ওখানে, এখন ওর বয়স বেয়াল্লিশ। মালকাটা থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসে আজ হয়েছে ওভারম্যান। ইয়াসিন মিঞা ওর জন্যে একখানা থান ইট বাড়িয়ে দিয়েছে। সেটাতেই জাঁকিয়ে বসেছে এককড়ি। মুখে বিড়ি, হাতে ধেনো।