বেঁটে-খাটো মোটা মানুষ। কদমছাঁট কাঁচা-পাকা চুল, চোখ দুটো ছোট ছোট। ধূর্ত সন্ধানী দৃষ্টি। মুখটা সূচালো–দেখলে কি জানি কেন মূষিকের কথা মনে পড়ে যায়। নাকে রসকলি, গলায় কণ্ঠী। পঞ্চানন ধর্মে বৈষ্ণব। ছেলেপুলে নেই। মালাচন্দন হয়েছিল যে ভাগ্যবতীর সঙ্গে, তিনি বাঁজা খাজা মানুষ। সেদিক থেকে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। কিন্তু সব সুখ কি ভগবান কারও কপালে লেখেন দরাজ হাতে? বৈষ্ণবী চিররুগ্না। সারাক্ষণ তার মাথা ঘুরছে, খক্ খক্ করে কাশছে, আর থুথু ফেলছে। শুয়েই থাকে দিনমান। তবে সংসারটা দেখে কে? দেখে ওর দূর সম্পর্কের বোনঝি, ছ্যাতরা। বাপ-মা মরা অভাগীটাকে নিয়ে এসেছে আজ বছর কয়েক। সে রয়ে গেছে এ সংসারে। দিবারাত্র কাজ করে যায় মুখ বুজে। জুতো সেলাই আর চণ্ডীপাঠ ছাড়া বাদবাকি সব কাজ করে যায়। পাঁচক, ঝি, মালি ও ধোপানি। প্রথম দিন চন্দ্রভান ভেবেছিল ঐ ছ্যাতরা বুঝি হালদারমশায়ের মেয়ে। ও আপন মনে ভেবেছিল দেশে এত পাখি থাকতে পাঁচুবাবু ছাতারে পাখিকে এতটা প্রাধান্য দিলেন কেন? পাপিয়া, মুনিয়া, টুনটুনি, বুলবুল, টিয়া, ময়না কি দোষ করল? মেয়েটি যখন পঞ্চাননকে মামা বলে ডাকল তখন চন্দ্রভান বুঝতে পারে ছাতরা ওর মেয়ে নয়, নামকরণটা পাঁচুবাবু করেন নি। তা এই পাঁচুবাবুর সংসারেই ওর আহারের আয়োজন।
কাজ শুরু করেছে চন্দ্রভান। সাহায্য পাচ্ছে আশাতীতভাবে। প্রথম কাজ হচ্ছে গীর্জাটা সাফা করে ফেলা। সেটা পরিদর্শন করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। দশ বিশজন মানুষ ইতিমধ্যে লেগে গেছে সেটা সাফা করতে। কোদাল চালিয়ে আশপাশের ফণিমনসা, আশশ্যাওড়া আর বনতুলসীর জঙ্গল সাফা করে ফেলেছে; ভাঙা ইটের স্তূপ সরিয়ে ফেলেছে; উইয়ের ঢিবি নির্মূল করে ফেলেছে। এখন উপড়ে ফেলা হচ্ছে দেওয়ালের ফাটল-বেয়ে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থের চারা। চন্দ্রভান খুশিয়াল হয়ে ওঠে ওদের উৎসাহ দেখে। বলে,- কী মুর্মু, তোমরা যে একদিনেই এটার চেহারা পালটে দিলে?
যোসেফ মর্মু কোদালটা নামিয়ে রেখে সেলাম করে। একগাল হেসে বলে, হাঁ আজ্ঞা। আজ আমরা কজন কেউ খাদে নামি নাই। ওভারম্যান সাব বললেন–যা তুরা, হুই গীরজা ঘরটো সাফা করি দে–হাজিরা মিলবে লগদালগদ!
ও, তাহলে ওরা ধর্মের টানে আসে নি। তা হোক, ওদের না থাক, কর্তৃপক্ষের ধর্মজ্ঞান আছে। চন্দ্রভানও লেগে যায় ওদের সঙ্গে কাজ করতে। সমস্ত দিনের পরিশ্রমে জায়গাটা বেশ সাফসুতরো হয়ে ওঠে। একটা সাপ মারা পড়ল। দুটো শেয়াল ছুটে পালাল। প্রভু যীশুর পরিত্যক্ত মন্দির আবার ভদ্র রূপ ফিরে পেল। আগামী রবিবার থেকে সে উপাসনা শুরু করবে এখানে। …
গীর্জাটা সুন্দর। লম্বাটে ধরনের। তা শ দুয়েক লোক একসঙ্গে বসতে পারে। মাঝখানের নেভ-অংশটা অপেক্ষাকৃত উঁচু-রাণীগঞ্জ টালির দোচালা। দুপাশে দুটি লিন-টু একচালা আইল। কয়েকটা ধাপ বেয়ে উঠে আসতে হয় স্যাচুয়ারিতে। কয়ার স্টলটা ভেঙে গেছে। রুডলফটটাও অক্ষত নেই। তার উপর ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিটা কিন্তু অক্ষত! অল্টার পীসের কাছে তিনভাঁজওয়ালা একটা কাঠের Teiptych। কাঠের ব্যাটেন, কাঠের প্যানেল–তাতে তেলরঙের ছবি; পনের-বিশ বছরেও একেবারে মুছে যায় নি। সম্ভবত ফাদার শারদাঁর হাতের কাজ। এ-পাশে অ্যানানসিয়েশান, ওপাশে ডিসেন্ট-ফ্রম-দ্য-ক্ৰশ আর মাঝখানে দ্য হোলি ফ্যামিলি। চন্দ্রভান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেই শিল্পকর্ম। রুডের দু-পাশে আরও দুটি ফ্রেসকো–মাতা মেরি এবং সেন্ট জন দি ঈভানজেলিস্ট। ছাদের উপর ফিনিয়াল আর ব্যাটলমেন্টগুলি ভেঙে গেছে এখানে-ওখানে। ও আর মেরামত করানো যাবে না, তবে মাঝখানের মূল ক্রুশকাঠটা সারাতে হবে। চন্দ্রভান তার চার্চের প্রেমে পড়ে গেল প্রথম দর্শনেই।
কুলি-ধাওড়ার অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, ভাব জমেছে। ওরা ওর একটা অদ্ভুত নামকরণ করেছে-ফাদারদা! চন্দ্রভান বারে বারে প্রতিবাদ করে বোঝাবার চেষ্টা করেছে–সে পাদ্রী নয়, ফাদার নয়। কিন্তু ওরা শোনে নি। আগে যে দাড়িআলা সাহেব এখানে থাকতেন তাঁকে ওরা বলত ফাদার। তা তাঁর বয়স হয়েছিল। চন্দ্রভান নেহাৎ নাবালক। বেশ তো, ফাদার যদি না হতে চায়, নাই হল–দাদা হতে তার আপত্তি কিসের? ওদের কুলি-ধাওড়াতেও গিয়েছে চন্দ্রভান। ধাওড়া তো নয়, শুয়োরের খোঁয়াড়। পাশাপাশি গাদাগাদি করে বানানো ছাপড়া–নরক। এক পশলা বৃষ্টি হলে শুধু ছাদ দিয়ে নয়, মেজে ফুঁড়েও জল আসে। একেবারে নন্দোৎসব। তবে ভরসা এটুকু যে, বর্ষার জল এখানে দাঁড়ায় না। বৃষ্টি থামলেই গেরুয়া রঙের জলের স্রোত হুড় হুড় করে ছুটে চলে নামালের দিকে, সিঙারণ নদীর দিকে সেখান থেকে শেষমেষ তিন মাইল দূরের দামোদরে।
চোরে কামারে দেখা হয় না। ভোর না হতেই মেট-মুন্সি পঞ্চানন তার ধড়াচূড়ো পরে বেরিয়ে যায়। খাকি হাফপ্যান্ট, ফিতে বাঁধা কোম্পানির দেওয়া জুতো, মাথায় টুপী। সূর্যোদয়ের আগেই নামে খাদে। দুপুরে তার খাবার নিয়ে যায় কোন কামিন। পঞ্চানন ফিরে আসে সন্ধ্যার পর। চন্দ্রভান যখন দুপুরবেলায় খেতে আসে তখন বাড়ির মালিক পাতালরাজ্যে। এক প্রহর রাতে আবার যখন আসে নৈশ আহারের সন্ধানে, পাঁচুবাবু তখন বারাঙ্গনা পাড়ার স্বর্গে। মর্ত্যের সঙ্গে পঞ্চাননের সম্পর্কটা সামান্যই– রাত দশটা থেকে ভোর রাততক। তখন মড়ার মত ঘুমায় মানুষটা। সূরযদেবের সঙ্গে তার মোলাকাত হয় হপ্তায় একদিন–ঐ রবিবার। অচেনা এই খেষ্টান ছোঁড়াটাকে দু বেলা দুটো খেতে দেবার এ উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিত না পাঁচুনিয়েছে দুটি কারণে। এক নম্বর, নাথানিয়াল সাহেবকে খুশি করতে। সাহেব নিজে তাকে ডেকে অনুরোধ করেছিলেন। আর দু নম্বর, ওর খোরাকিবাবদ অনেকগুলি মুদ্রা সে আদায় করবে কায়দা করে। কি খাওয়াচ্ছে, কতটা খাওয়াচ্ছে তা আর নিক্তি ধরে কে ওজন বুঝে নেবে?