ভিন্সেন্টকে বাবুই বলেছিলেন। বঙ্গবাসী ঐ অষ্টাদশবর্ষীয় নেহাৎ চ্যাঙড়া মানুষটা যাতে খ্রীষ্টধর্মের বিশ্বভ্রাতৃত্বের অজুহাতে বেশি ঘনিষ্ঠ না হতে পারে তাই প্রথম থেকেই তিনি সজাগ হলেন।
খোদ ম্যানেজারসাহেবের বাঙলোটি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। সে বাড়িটা আরও বড়, আরও ভাল, আরও সাজানো-গোছানো। ম্যানেজারসাহেব খাঁটি ইংরাজ-রাজার জাত। বর্তমানে ছুটিতে। হোমে। তাই গোয়ানিজ নাথানিয়ালই এখন এ-অঞ্চলের হর্তাকর্তা এবং বিধাতা। কোম্পানির একমাত্র প্রতিভূ। তার একান্তসচিবকে ডেকে তিনি বলে দিলেন চন্দ্রভানের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে। তা ভালই ব্যবস্থা হয়েছে। কয়লাকুঠিতে ভদ্দরলোকদের ভিতর একমাত্র খোদ নাথানিয়ালই খ্রীষ্টান। বাবুদের মধ্যে আর কেউ খ্রীষ্টান নেই। সব হীদেন! কুলি-ধাওড়ায় যারা বাস করে– বাগদি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, গোণ্ড, ভুঁইহার ওদের ভিতর অনেকেই এককালে সদ্ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল, পনের-বিশ বছর আগে। তখন তারা উপাসনাও করত, বড়দিনও করত, প্রতিদিন আহারে বসে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করত, গীর্জায় সমবেত হত প্রতি রবিবার সকালে, হাটে যাবার পথে। তারপর পাদরি সাহেব চলে গেলেন, ওরাও সে-সব কথা ভুলে মেরে দিল। গীর্জাটা উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে এক যুগ। জানালার পাল্লাগুলো খুলে গেছে, ফাটল দেখা দিয়েছে পাকা-ইটের-দেওয়ালে, বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে সেখানে, কেউ ভ্রূক্ষেপ করে নি। বছরে বছরে রৌদ্র বৃষ্টিতে তারা দিব্যি বেড়ে উঠেছে। দু-চারটে শেয়াল ছাড়া ওদিকে বড় কেউ যায় না। গীর্জার দরজার চালাটায় মরচে ধরে গেছে। কুলি-ধাওড়ার কয়েকটি পরিবার যে খ্রীষ্টান তা শুধু বোঝা যায় তাদের নামগুলি শুনে। যোসেফ মুর্মু, ডেভিড মাহাতো, কিংবা ঈশাক রুহিদাস। ওরা বোঙামায়ের পূজা চড়ায়, বাবা কুড়ুংতুল্লার কাছে শুয়োর বলি দেয়, দোলের দিনে আবীর মাখে। তবু বড়দিনের উৎসবে পরধান যখন বোঙামায়ের নামে জোড়া কুঁকড়া বলি দিয়ে বোঙামায়ের জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে তখন প্রৌঢ় যোসেফ মুর্মু নিমীলিত নেত্রে সায় দেয়,-আমিন! বুকের উপর ক্রুশচিহ্ন এঁকে বোঙামায়ের পূজা সমাপ্ত করে।
অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার নাথানিয়াল সাহেব তার বিচিত্রভাষায় বলেছিলেন, বাবু, এই জানোয়ারগুলোকে তুমি মানুষ কর। দে আর অল হীদেন নিগারস্!
চন্দ্রভান সেই ব্রত গ্রহণ করেই এসেছে। সে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
কুলি-ধাওড়ায় তার পক্ষে থাকা চলে না। আবার বাবুদের কারও ডেরায় খ্রীষ্টানের ঠাঁই হবে না। তাই ম্যানেজার ওর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন নিজ আস্তাবলে। আস্তাবল পবিত্র স্থান। দুহাজার বছর আগে অমন এক স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সদ্ধর্মের আদি পুরুষ। সাহেবের ঘোড়াটি মারা গেছে। অভাগা তিনি নন, সাহেব সম্প্রতি একটি হাওয়া গাড়ি কিনেছেন। কলের গাড়ি। ঘোড়া নেই, সহিস নেই, কোচম্যান নেই– সাহেব চাকা ঘোরান আর পাঁই পাঁই করে ছোটে কলের গাড়ি। আধঘন্টায় বরাকর, একঘন্টায় আসানসোল। অবাক গাড়ি। নাম মটোর!
তাই ঐ আস্তাবলেই আশ্রয় পাওয়া গেল। সাহেবের নির্দেশ এল বাবুইঘাসে বোনা দড়ির খাটিয়া। এনে দিল লণ্ঠন। বরাদ্দ হল কেরোসিনের। মায় সাহেব নিজের বাতিল করা একখানা টেবিল আর চেয়ারও পাঠিয়ে দিলেন। পাকা ঘর, পাকা মেঝে, মাথার উপর রাণীগঞ্জ টালির পাকা ছাদ। এ তো স্বর্গ! ঘোড়ার জল খাওয়ার বিরাট পাত্রটা ওর স্নানের চৌবাচ্চা। সাহেবের মালি সেটা ধুয়ে-মুছে সাফা করে জলে ভরে দিল।
আহারের আয়োজন অবশ্য বাবুদের কোয়ার্টার্সে। এখানে নয়। সে ব্যবস্থাও হল। তিন নম্বর পিটের মেট-মুন্সি পাঁচু হালদারের বাড়ি দু-বেলা দুমুঠো খেয়ে আসতে হবে। পাঁচু মেট-মুন্সি বাবু-শ্রেণীর লোক নয়। কুলির সর্দার। কয়লা কুঠির আইন-মোতাবেক তার থাকার কথা কুলি-ধাওড়ায়। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে বলেই না আইনটাকে আইন বলে মানি? আর দুটি পিটের মেট-মুন্সির যে সৌভাগ্য হয় নি, পাঁচুর তা হয়েছিল। সে ভদ্রসন্তান। অন্যান্য মেট মুন্সিদের মত সে টিপছাপ দেয় না। রীতিমত সই করে মাইনে নেয়। বাঙলায় নয়, ইংরাজী সই। লেখাপড়া-জানা মানুষ। অনেক দিন থেকে আছে এখানে। কোন্ সুদূর অতীতে ঐ লেখাপড়া-জানা মানুষটা একদিন এসেছিল মালকাটা কুলি হিসাবে নাম লেখাতে। মালকাটা হতে হয় নি তাকে–সে চাকরি শুরু করে। গিনতিদার হিসাবে। কটা টব কোন্ গ্যাং ভর্তি করল তার গুতি রাখত। তা গঙ্গার ঢেউ গুণেও বুদ্ধিমান মানুষ টাকা কামায়, আর এ তো কালো হীরে। পঞ্চানন দু-হাত্তা কামিয়েছে সে আমলে। লোকটা সকলের উপকার করে, সকলের ফাইফরমাস খাটে। সকলের প্রিয়। মায় সামান্য গিনতিদারটা খোদ ম্যানেজারের পর্যন্ত নজরে পড়ে যায়। কর্তৃপক্ষ এই কাজের মানুষটাকে না পারে রাখতে, না পারে তাড়াতে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ওকে প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হল। গিনতিদার থেকে মেট-মুন্সি। আর তোমাকে টব গুণতে হবে না বাবা, এবার রেহাই দাও। বরং কুলি খাটাও এবার। পঞ্চানন তাতেও খুশি। টবের বদলে এখন মানুষ গোনে–রোজগার তার ঠিক আছে। সব দেবতার থানেই সেলাম বাজিয়ে চলে। সকলকেই খুশি রাখে। তাই ওর ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রমটা সম্ভবপর হয়েছে। মেট-মুন্সি টালির কোয়ার্টার্স পেয়েছে। আছে বাবুপাড়ায়।