চন্দ্রভান জিজ্ঞাসা করেছিল,–আমি যদি বাওয়ালীতে থেকেই কাজ করি, তাতে ক্ষতি কি?
কিন্তু এ ব্যবস্থাপনায় ফাদার শারদাঁ রাজী হতে পারেন নি। বলেন, এ-গ্রামে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কোন পরিকল্পনা তার নেই। তিনি এখানে সম্পূর্ণ নূতনভাবে একটি পরীক্ষাকার্য করতে চান। তাছাড়া ঊর্মিলা প্রতি ছুটিতে বাওয়ালীতে আসে। চন্দ্রভান ওর দৃষ্টির অন্তরালে থাকুক, এটাই ফাদার শারদাঁর ইচ্ছা। বলেন, আমি পনের বৎসর পূর্বে আসানসোলের নিকটে একটি কয়লাখনিতে খ্রীষ্টধর্মের প্রচার করিতাম। আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি আসানসোল মেথডিস্ট চার্চের রেভারেণ্ড মার্লোকে একটি পরিচয়পত্র দিতে পারি। কয়লাখনির মানুষগুলি বড় দুঃস্থ, বড় অসহায়। ঈশ্বরের আশীর্বাদ তাহাদের নিতান্ত প্রয়োজন।
চন্দ্রভান রাজী হয়ে যায়।
তার ক্যাম্বিসের ব্যাগ আর বিছানার বাণ্ডিলটা বগলে নিয়ে একদিন সে রওনা হয়ে পড়ে আসানসোলের উদ্দেশে। পাঠাশালার পড়ুয়ার দল সার দিয়ে দাঁড়াল ওকে বিদায় জানাতে। ন’পিসি রাধাগোবিন্দজীর প্রসাদী ফুলটা গুঁজে দিলেন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকের বুক পকেটে; আর ভিন্সেন্ট ভান গর্গ তার ধর্মগুরুর কাছে বিদায় নিল তার পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিয়ে। রেভারেণ্ড অর শারদাঁ এতে বিসদৃশ কিছু দেখলেন না–চরণ দুটি সরিয়ে নিলেন না, বরং বলিরেখাঙ্কিত দুটি হাত ওর মাথায় রেখে আশীর্বাদ করলেন।
০৫-৬. আসানসোল মেথডিস্ট চার্চ
আসানসোল মেথডিস্ট চার্চের প্রধান যাজক রেভারেণ্ড জোশেফ মার্লো পরিচয়পত্রখানি পড়ে খুশি হলেন। চন্দ্রভানকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, আপনাকে আমরা সাদরে গ্রহণ করছি। পাশেই বসেছিলেন তার সহকারী ব্রাদার দাভিদ। তাঁকে বলেন, এ ভালই হল-জোড় জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে খ্রীষ্টধর্মের প্রচার আজ পনের বছর ধরে বন্ধ আছে। ফাদার শারদাঁ ঐ কোলিয়ারি থেকে ফিরে আসার পর ওখানে কোনও কাজ হয় নি।
ব্রাদার দাভিদ ভিন্সেন্টকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন। জোড়-জাঙ্গাল কয়লাখনি একটি পাণ্ডববর্জিত দেশ। কেউ সেখানে ধর্মপ্রচারের ব্রত নিয়ে যেতে চায় না। কয়েক ঘর খ্রীষ্টান সেখানে আছে, একটি পরিত্যক্ত চার্চও । আছে। আপাততঃ ঈভানজেলিস্ট হিসাবে সেখানে কাজ করতে যাবে; ভিন্সেন্ট তার কাজে সন্তুষ্ট হলে পরে তাকে প্রীস্ট করে দেওয়া হবে।
চন্দ্রভান প্রশ্ন করেছিল,ঈভানজেলিস্ট আর প্রীস্টের তফাত কি?
–এই দেখুন। তাও জানেন না আপনি! আপনাকে শিক্ষানবিশী হিসাবে দীর্ঘদিন ট্রেনিং নিতে হবে কাজ শিখতে হলে। হোমে ঈভানজেলিস্ট হিসাবে কাজ করতেও পরীক্ষায় পাস করতে হয়। অতটা কড়াকড়ি অবশ্য এখানে আমরা করি না। আপনি খ্রীষ্টান শ্রমজীবীদের সেবা করবেন, ধর্মপথে যাতে ওদের মতি হয় তা দেখবেন, প্রতি রবিবারে বাইবেল থেকে ওদের পড়ে শোনাবেন ও ব্যাখ্যা করে বোঝাবেন। কিন্তু মনে। রাখবেন, আপনি প্রীস্ট নন, ঈভানজেলিস্ট মাত্র। তাই কারও কফেশন আপনি শুনতে পারবেন না। সে প্রয়োজনে আমাদের খবর পাঠাবেন। আমি অথবা ব্রাদার দাভিদ আপনাকে সাহায্য করতে যাব।
-আমি থাকব কোথায়? খাব কী?
–সে আমাদের দায়িত্ব। ওখানে কয়েক ঘর খ্রীষ্টান আছেন। তাঁদের কারও বাড়িতে আপনার বাসাহারের ব্যবস্থা করে দেব। এ ছাড়া মাসে মাসে আপনাকে নগদ পাঁচ টাকা পকেট অ্যালাউন্সও দেওয়া হবে।
চন্দ্রভান রাজী হল। যাত্ৰামুহূর্তে ফাদার মার্লো ওকে ডেকে বললেন, একটা কথা মিস্টার গর্গ। মনে রাখবেন, ওখানকার শ্রমিকেরা মানুষ নয়। ক্রিশ্চিয়ান অর নো ক্রিশ্চিয়ান, দে আর অল হীদেনস!
চন্দ্রভান অবাক হয়ে যায়। বুঝতে পারে না। খ্রীষ্টান হলে আর কেমন করে মানুষে হীদেন থাকতে পারে? ফাদার মার্লো বুঝিয়ে দিলেন,–ওরা প্রভু যীসাস, বোঙা মাঈ আর কুডুংতুল্লার মধ্যে কোন প্রভেদ বুঝতে পারে না। মা মেরীর পূজা দেয় মুরগী বলি দিয়ে। অল-সেন্টস-ডে উদযাপন করে শুয়োর বলি দিয়ে, মাদল বাজিয়ে নাচ-গান করে, আর হাঁড়িয়া খেয়ে! মানুষ নয় ওরা–পশু!
চন্দ্রভান বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে।
আজ কদিন হল চন্দ্রভান এসে উঠেছে জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে। জায়গাটা সত্যই পাণ্ডববর্জিত। আসানসোল থেকে প্রায় চৌদ্দ ক্রোশ। এতটা পথ অবশ্য তাকে হেঁটে আসতে হয়নি। ফাদার মার্লো ওকে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। বরাকর স্টেশন থেকে হাঁটাপথে মাঠামাঠি পাড়ি দিয়েছে পাক্কা সাত মাইল। এক বগলে বিছানার বাণ্ডিল, অপর হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
এখানকার সবকিছুই অজানা, অচেনা। অবাক হতে হয় সব কিছুতেই। লাল কাঁকরে বন্ধ্যা মাটি-মাথা খুঁড়লেও কোদালের মাথায় মুঠভর মাটি ওঠে না, ঘাসের চাপড়া ঠেকে না। মাঝে মাঝে পাথুরে আউটক্রপ; কিছু দূরে দূরে বিরাট গর্ত। মুরাম-মাটি উঠিয়ে নিয়ে গেছে শাহী সড়কের পাড় বাঁধতে। বিরাট অজগরের মত শাহী সড়ক চলে গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। লালে লাল। এই রাঙামাটির সমুদ্রের মাঝখানে নিকষকালো জোড়-জাঙ্গাল কয়লাকুঠি যেন পলাশফুলের মাঝখানে একটি কালো ভোমরা। এর চৌহদ্দির মধ্যে যদি একবার ঢুকে পড়, দেখবে তোমার রঙিন স্বপ্ন নিঃশেষে মুছে গেছে কয়লার কালিমায়।
একধারে কয়লাতোলার আয়োজন, কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া। বিরাট লোহার ফটক, তার সামনে গাদা বন্দুক হাতে পাহারা দেয় গুর্খা সেপাই। ত্রিসীমানায় গেলেই হাঁকাড় পাড়ে, হুঁশিয়ার! কাঁটা তারের বাইরে মালকাটাদের বাস। বেশ কিছু দূরে। সার দিয়ে বানানো হয়েছে তাদের কুলি-ধাওড়া। ওরা অন্তেবাসী, ওদের এলাকাটা স্বতন্ত্র। এ-পাশে খানকতক খাপরাটালির ঘর। কোম্পানির কর্মচারী বাবুদের আস্তানা। ওভারম্যান, হিসাববাবু, আমিনবাবু, টাইপবাবু, খাজাঞ্চিবাবুদের আস্তানা। ওঁরা ঐসব মালকাটা মজদুরদের জীবনযাত্রা থেকে স্বাতন্ত্র রক্ষা করে টিকে আছেন খাপরাটালির পাকাবাড়িতে। আবার এদের মহল্লা থেকে বেশ কিছুটা দূরে টিলার মাথায় দুটিমাত্র পাকাবাড়ি। বাগান ঘেরা সুন্দর ছিমছাম সাহেব কুঠি। ওদিকপানে তোমার-আমার যাওয়া মানা। ত্রিসীমানায় কেউ গেলেই পেডিগ্রিওয়ালা বিলাতী কুকুর তারস্বরে প্রতিবাদ জানাবে। ও দুটি বাড়ির ছোটটিতে থাকেন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার নাথানিয়াল সাহেব। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ-গোয়ানিজ ক্রিশ্চিয়ান। দশাসই চেহারার মধ্যবয়সী মানুষ। মোম দিয়ে পাকানো একজোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ। পরনে হাফপ্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে খাকি সার্ট, হাতে ব্যাটন। সাহেব একাই থাকেন। মেমসাহেব ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করেন কলকাতায়। ওবাড়িতে আছে কিছু মালি, পাঁচক, বেয়ারা, খিদমদগার। আর ছিল একটা ঘোড়া। সেটা মরে বেঁচেছে। সাহেব হিন্দি বলতে পারেন ভাঙাভাঙা। ফাদার মার্লোর চিঠিখানি পড়ে খুশি হয়েছিলেন সাহেব। বলেছিলেন, আমি অ্যারেঞ্জমেন্ট করিয়া ডিবে। আয়াম হ্যাপী দ্যাট য়ু হ্যাভ কাম টু ওয়ার্ক ফর দীজ হীদেনস বাবু!