বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ান। বুকের উপর ক্রুশ চিহ্ন আঁকেন। তারপর অশান্তভাবে কয়েকবার পদচারণ করে ফিরে এসে বলেন–আপনি সত্য কথা বলুন–ধর্ম ত্যাগের সহিত, পার্থিব কোন বাসনা কামনা জড়িত আছে কি?
মাথাটা নিচু হয়ে যায় চন্দ্রভানের, বলে–আছে! আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি ঊর্মিলা দেবীর পাণিগ্রহণ করতে চাই।
আমিও এমত অনুমান করিয়াছিলাম। আপনি কি তাঁহার সম্মতি লাভ করিয়াছেন?
না, তার সম্মতি পাই নি এখনও। তবে আশা রাখি পাব। কিন্তু ঐ সঙ্গে এ কথাও আমি জানিয়ে রাখতে চাই ফাদার, আমার এ সিদ্ধান্ত তার অনুমতিসাপেক্ষ নয়। ধর্মজীবনটা আমার নিজের, কর্মজীবনটাই অপরের অনুমতিসাপেক্ষ। তিনি শেষ পর্যন্ত আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি মর্মাহত হব নিশ্চয়, কিন্তু তাতে আমার খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত বদলাবে না।
আপনি প্রকৃত তত্ত্ববিজ্ঞানীর মত কথা বলিয়াছেন। কিন্তু একটা কথা
সরল সাধক মানুষটি এবার যা বললেন তা রীতিমত সংসারভিজ্ঞের মত। তাঁর বিচিত্র ভাষায় চন্দ্রভানকে বুঝিয়ে দিলেন–আইনতঃ তিনি মিস্ ঊর্মিলা শারদাঁর অভিভাবক নন। ঊর্মিলার বয়স ষোলো বৎসর তিন মাস। সে সাবালিকা হবার পর অবশ্য তাকে পিতার অনুমতির অপেক্ষায় থাকতে হবে না। সুতরাং আগামী দুবছর চন্দ্রভানকে অপেক্ষা করতেই হবে। দ্বিতীয়তঃ, চন্দ্রভান জমিদারের ছেলে। ধর্মান্তর গ্রহণ করলে সে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এ কথাটাও যেন সে ভেবে দেখে। তৃতীয়তঃ, গার্হস্থ্যজীবনে প্রবেশ করার আগে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। উপার্জনক্ষম হতে হবে। জীবনে তার লক্ষ্য কী তা স্থির করতে হবে। চতুর্থতঃ, খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হলে তাকে ঐ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন পাদরির দ্বারস্থ হতে হবে। ফাদার শারদাঁ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত।
চন্দ্রভান এবার দৃঢ়স্বরে বলে-ফাদার! আপনি যদি নিজে আমাকে ব্যাপটাইস না করেন তবে বুঝব খ্রীষ্ট-প্রচারিত ধর্মও আমাদের বার ব্রত তিথি-নক্ষত্রের বেড়াজালে আটকানো হিন্দুধর্মের মতই একটা পঙ্কিল ধর্ম! তাহলে আমি খ্রীষ্টান হতে চাই না!
বৃদ্ধ দুই হাত প্রসারিত করে বললেন–আপনি ক্ষান্ত হন। আপনি আমাকে গভীর সমস্যায় নিক্ষেপ করিয়াছেন। But you are downright correct! আপনি আমাকে একদিন সময় দিন। আমি বিবেচনা করি।
চন্দ্রভান অভিবাদন করে বেরিয়ে আসছিল। তাকে ফিরে ডাকলেন ফাদার শারদাঁ; বললেন-আপনিও একটি দিন আপনার নিজের সহিত বোঝাপড়া করুন। দেখুন, এ আপনার অন্তরের নির্দেশ কিনা।
পুনরায় অভিবাদন করে বেরিয়ে এসেছিল চন্দ্রভান।
নিজের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি।
দাঁড়ান!
চন্দ্রভান মুখ তুলে দেখেছিল আজ ঊর্মিলাই দাঁড়িয়ে আছে তার পথরোধ করে। আজ আর সে ছলনাময়ী প্রগলভা মেয়েটি নয়। চন্দ্রভান বললে, কিছু বলবে?
-হ্যাঁ! কেন আপনি খ্রীষ্টান হচ্ছেন?
আড়াল থেকে সবই শুনেছ আশা করি।
–শুনেছি। আপনি কিন্তু ভুল করছেন। এভাবে নিজেকে ঠকাবেন না। যীসাকেও ঠকাবেন না।
-কি বলতে চাইছ ঊর্মিলা?
–বলতে চাইছি, আপনি ধর্মের জন্য ধর্মত্যাগ করছেন না, করছেন
–শেষ কর! তোমার জন্য! তাই নয়?
কিন্তু আমাকে আপনি পাবেন না, এটা জেনে রাখুন।
–এ কথা তুমি আগেও বলেছ ঊর্মিলা। দুটো কথা আমি বলব। প্রথম কথা, যদি তোমার জন্যই আমি আজ ধর্মকে ত্যাগ করি, তাতে প্রমাণ হয় তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি। দ্বিতীয় কথা, আমি বিশ্বাস করি প্রেম বিশ্বজয় করতে পারে–তুমি তো সামান্য একটা মেয়ে।
হাসির উৎস বুঝি ফুরিয়ে গেছে প্রগলভা মেয়েটির। হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলেনা, না, এ হবার নয়, বিশ্বাস করুন! পাগল! আপনি বদ্ধ পাগল!
ফাদার শারদাঁ শেষ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। দীক্ষা দিলেন চন্দ্রভানকে। ওর ক্রিশ্চান নাম হল ভিন্সেন্ট। গোটা নামটা মস্ত বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে শারদাঁ বললেন, নাম হোক ভিন্সেন্ট চন্দ্র গর্গ। ব্যবস্থাটা ভাল লাগে নি চন্দ্রভানের। বলেছিল, ওর ভাইয়ের নাম সূরযভান, ভাইয়ের সঙ্গে যোগসূত্রটুকু ছাড়তে রাজী হল না। তাই ওর নতুন নাম হল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ!
ফাদার শারদাঁ শেষ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন, পারল না ঊর্মিলা।
চন্দ্রভান যেদিন দীক্ষা নিল সেইদিনই সে তড়িঘড়ি ফিরে গেল কলকাতায়।
ফাদার শারদাঁর যুক্তিটা মেনে নেয় ভিন্সেন্ট। ঊর্মিলাকে সময় দিতে হবে। শারদাঁ বলেছিলেন, এক্ষেত্রে যতদিন না ঊর্মিলা সাবালিকা হয় ততদিন ভান গর্গকে অন্তরালে সরে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে সে যেন তার জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক করে নেয়। ঈশ্বর ওকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিশেষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। কী সে উদ্দেশ্য তা নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়।
ভিন্সেন্ট বললে, মানুষের বড় দুঃখ। আমি ঐসব দুঃখী মানুষদের সেবা করতে চাই। প্রকৃত সেবাব্রতী খ্রীষ্টানের মত। আপনার মত। আপনি আমাকে সুযোগ করে দিন শুধু। আমি খ্রীষ্টধর্মের প্রচারে আত্মনিয়োগ করতে চাই।
–এ অতি উত্তম প্রস্তাব; কিন্তু প্রভু যীশুর ধর্ম প্রচার করিবার পূর্বে আপনাকে সে কার্যের উপযুক্ত হইতে হইবে।
ছবি আঁকার আগে জমি তৈরী করতে হয়। ফাদার শারদাঁ বসলেন ওকে নিয়ে সেই কাজে।
ঊর্মিলা কলকাতায় ফিরে এসেছে। চন্দ্রভান রাত থাকতে ওঠে। প্রদীপ জ্বেলে পড়তে বসে। বাইবেল, খ্রীষ্টধর্মের বিষয়ে নানান গ্রন্থ, সন্ত মার্ক লিখিত সুসমাচারে প্রভু যীশুর জীবনী, এমন কি মেরী বেকার এডি লিখিত ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের গ্রন্থ। খ্রীষ্টধর্মের ইতিহাস, রোমান ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে মার্টিন লুথারের মতবিরোধ, জার্মান হল্যাণ্ড-স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান চার্চ-সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ, প্রটেস্টান্ট ধর্মের জন্ম, চার্চ-অব ইংল্যাণ্ডের আবির্ভাব, এবং তারপর আবার নূতন নূতন চিন্তাধারা–জর্জ এক্স-প্রবর্তিত সোসাইটি অফ ফ্রেণ্ডস বা কোয়েকারস। জন ওয়েসলে-প্রবর্তিত মেথডিসম, নন্ কনফার্মিস্ট ফ্রি-চার্চগুলির বক্তব্য–সবই একে একে ধারাবাহিকভাবে মুখে মুখে শিখিয়ে গেলেন শিষ্যকে। বলেন, খ্রীষ্টধর্মের ভিতর যুগে যুগে অন্যায়-পাপ-সংকীর্ণতা-অবিচার প্রবেশ করেছে, আর যুগে যুগে উদারনৈতিক ধর্মপ্রচারকের দল সেই ক্লেদ দূরীভূত করে চার্চকে নিষ্কলুষ করে গেছেন। বলতেন, মনে রাখবেন, ধর্মের সবচেয়ে বড় কথা ক্যাথলিসিটি-উদারতা, পরধর্মসহিষ্ণুতা। তাই প্রভু যীশুর বাণী প্রচার করতে হলে আপনাকে জানতে হবে অপর ধর্মের কথাও। তাই শেখাতেন অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের জীবনী ও বাণী। গৌতম বুদ্ধ ও জৈন তীর্থঙ্করদের কাহিনী শোনাতেন ব্রাহ্মণ সন্তান চন্দ্রভান গর্গকে শেখালেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূল তত্ত্ব–সাঙ্খ্য, বেদান্ত, উপনিষদের বক্তব্য। শোনালেন কোরাণের হজরত মহম্মদ ও আবুবকরের সংগ্রামের ইতিকথা, কনফুশিয়াস আর লাও-সে প্রবর্তিত ধর্মের বাণী। আর সব শেষে বললেন,আপনি ঠাকুর রামকৃষ্ণের ঐ কথাটি কখনও ভুলবেন না–যত মত তত পথ!