রাত্রে বিছানায় শুয়ে সেই কথাই ভাবছিল চন্দ্রভান। জাত আর ধর্ম তো এক নয়! কী ক্ষতি হবে দুনিয়ার, সে যদি আজ খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে? এই হবে চরম প্রতিশোধ। চাবুক তার নিজের পিঠে পড়ে নি সেদিন, পড়েছিল অন্যত্র। ও নিজেও প্রতিপক্ষের উপর চাবুক চালাবে। বিসর্জন দেবে তার জাত! এতে যদি কারও পিঠে চাবুক পড়ে, তবে সে নাচার! উত্তেজনায় সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরময় পায়চারি করে। ঠিক কথা! কালই বলতে হবে ফাদার শারদাঁকে। এভাবেই সে প্রতিশোধ নেবে! পূর্বজন্মে সে যবন ছিল। ত্রিকালজ্ঞ সন্ন্যাসী জানতেন যে, ম্লেচ্ছ ধর্ম গ্রহণ তার অনিবার্য নিয়তি। তাই বলে উঠেছিলেন–যবন কাহাকা।
ম্লেচ্ছ ধর্ম! যে ধর্ম জ্ঞানবুদ্ধি মতে গ্রহণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন, গ্রহণ করেছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, যে ধর্ম নিজে আচরণ করে দেখেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তা কেন অশ্রদ্ধেয় হবে! সেন্ট জন, সেন্ট সিবেস্টিয়ান, সেন্ট পল, সেন্ট জেভিয়ার–এঁদের পূত জীবন কথা, এঁদের আত্মোৎসর্গের কথা কি শোনেন নি চন্দ্রভান? এঁদের সাধনা কি বুদ্ধ-চৈতন্য-বিবেকানন্দের চেয়ে খাটো? শিশু যীশু ক্রোড়ে মা মেরীর ছবির সঙ্গে মা যশোদা বা গণেশজননীর প্রভেদ কোথায়?
আর তাছাড়া ঊর্মিলা?
ঊর্মিলা রহস্যময়ী। সেদিন নিশ্চয়ই একটা বাজে ওজর তুলেছিল সে। ঊর্মিলা তাকে ভালবাসে। এ সত্য সূর্যোদয়ের মত স্পষ্ট। তার মনের মানুষ যদি কলকাতাতেই থাকবে তবে কেন সে ছুটির পরেও পড়ে আছে এখানে? কেন চলে যায় না কলকাতায়? আসার পর থেকে ঊর্মিলার প্রতিটি দিনের আচরণ আবার যাচাই করে নেয়। না, ভুল তার হয় নি। ঊর্মিলার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি ইঙ্গিত একটি ধ্রুবসত্যের দিকে নির্দেশ করছে! ঊর্মিলা জানে, তাদের দুজনের মধ্যে আছে জাতের বাধা। দুরতিক্রম্য সে বাধা। তাই একটা মনগড়া বাধার সৃষ্টি করে সে চন্দ্রভানকে একটা মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চায়। চন্দ্রভানকে রক্ষা করতে চায়। তার ধর্মকে রক্ষা করতে চায়। চন্দ্রভান সব বোঝে! সে ফুলও নয়, সে নেভও নয়–সে প্রেমিক!
.
পরদিনই ঊর্মিলাকে জনান্তিকে পাকড়াও করে ফেলে। এ কদিন ঊর্মিলা রীতিমত এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিল; কিন্তু আজ চন্দ্রভানও মরিয়া হয়ে উঠেছে। কুয়োতলাতে যেই ঊর্মিলা জল তুলতে এসেছে অমনি কলসিটা হাতে নিয়ে সেও উপস্থিত।
-তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
ঊর্মিলা মুখ টিপে হেসে বললে, সেদিনের মত সিরিয়াস কথা নয় নিশ্চয়।
-না, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণই! সেদিন তুমি যে কথাটা বলেছিলে সেটা বাজে ওজর, তাই নয়?
–সেদিন তো কত কথাই বলেছিলাম। ঠিক কোনটা বলুন তো?
–তুমি একটি ছেলেকে ভালবাস!
খিলখিল্ করে হেসে ওঠে ঊর্মিলা। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, ঠাকুরমশায়ের কি হিংসে হচ্ছে না কি?
চন্দ্রভান ধমক দেয়–কী ইয়ার্কি হচ্ছে! বল, সত্যি করে বল–আমি যদি তোমাকে বিবাহ করতে চাই
ঊর্মিল হাসি থামায়। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথাগুলিই পুনরুক্তি করে আপনি কি পাগল হয়ে গেছে চন্দ্রভানবাবু। এ সব কী বলছেন? আপনি নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ
–সেটাই কি একমাত্র বাধা?
আবার হেসে ফেলে। হাসি ওর একটা রোগ। বলে–তা কেন? বাধা আরও কত আছে!
আমার চেহারা কি তার মধ্যে একটা?
এতে হাসির কি আছে? আবার খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে ঊর্মিলা, বলে–ষাট বালাই! কোন্ শত্তুর এমন কথা বলে? তাই তো অগস্ত্য-যাত্রার দিন এসে হাজির।
তার মানে?
আপনি এসেই বললেন, এই দেখ আমি পয়লা নম্বর কার্তিক।
–তুমি কি একটুও সিরিয়াস হতে পার না ঊর্মি?
সিরিয়াস কথাটা যে আপনি বিশ্বাস করছেন না। আমার সঙ্গে একটি ছেলের বিয়ে স্থির হয়ে আছে।
ফাদার শারদাঁ জানেন?
–কী পাগল আপনি! লুকিয়ে প্রেম করলে কি গুরুজনদের বলতে হয়?
এই প্রগলভা মেয়েটিকে কেমন করে বাগে আনবে বুঝে উঠতে পারে না চন্দ্রভান। ও অত্যন্ত মুখরা, লজ্জা-সরমের বিন্দুমাত্র নেই! কী নির্লজ্জের মত বললে কথাটা! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্রভান।
–তবে আপনার একটা জিনিস আছে গর্ব করবার মত!
–কী?
-আপনার কান দুটো! এত বড় বড় খরগোশের মত কান আমি কোনও ছেলের দেখি নি।
চন্দ্রভানের ডান হাতটা নিজের অজ্ঞাতসারেই চলে যায় কানের দিকে। অমনি খিলখিলিয়ে হাসির জলতরঙ্গে ভেঙে পড়ে ঊর্মিলা।
–আপনার প্রেমে না পড়লেও আপনার লম্বকর্ণ দুটির প্রেমে আমি সত্যিই পড়ে গেছি! আপনার কান দুটো আমাকে উপহার দেবেন?
চন্দ্রভান কি একটা জবাব দিতে চায়; কিন্তু তার আগেই দেখে ন’পিসিও আসছেন কুয়োতলায় জল তুলতে।
.
কিন্তু রাজী হলেন না ফাদার শারদাঁ। বললেন–কেন আপনি ধর্মত্যাগ করিতে চান তাহা আমাকে বলুন। আমি তো মনে করি হিন্দু ধর্মেও মানুষ ঈশ্বরের কাছে যাইতে পারে।
চন্দ্রভান বললে আপনিই বলেছেন, যত মত তত পথ!
না, ঠাকুর বলিয়াছিলেন!
বেশ, তাই না হয় হল; কিন্তু কে কোন্ পথে যাবে তা তো সেই বেছে নেবে। হিন্দু ধর্মের পথে যদি ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়, তবে খ্রীষ্টান ধর্মের পথেও তা যাওয়া যাবে। আমি যদি তাই পছন্দ করি?
কিন্তু আমি তো হিন্দু ধর্মের মর্মকথা বুঝিয়াও আপন ধর্ম বিসর্জন দিই নাই।
–তাতে কি হল? আমি যদি দিই, আপনার আপত্তি কোথায়? নাকি আপনি মনে করেন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ পাপ কাজ?