আচ্ছা কোম্পানির বাগানে সেই সন্ন্যাসী কেন বলেছিলেন-যবন কাহাকা! যবন? মানে খ্রীষ্টান? ও যদি খ্রীষ্টান হত তাহলে কার কি ক্ষতি হত? ক্ষতি নয় লাভই হত। হাত পুড়িয়ে ওকে রান্না করতে হত না। ঊর্মিলাই রেঁধে খাওয়াতো তাকে। আচ্ছা ঊর্মিলা কি–? ঊর্মিলা মেয়েটা বড় অদ্ভুত। ওর অর্ধেক কথা বোঝাই যায় না। ওদের স্কুল নিশ্চয় খুলে গেছে। মেয়েটা তো হস্টেলে ফিরে গেল না! কেন?
হঠাৎ কার যেন ছায়া পড়ল ঘরের ভিতর খোলা দরজা দিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে চন্দ্রভান দেখে দোরগোড়ায় ঊর্মিলা এসে দাঁড়িয়েছে।
–এমন চুপচাপ শুয়েও থাকতে পারে মানুষ! বাব্বাঃ!
চন্দ্রভান চোখ দুটি বুজে বলে, রবিবারেও জ্বালাতে আসা হয়েছে!
উঠুন উঠুন। অনেক কাজ আছে
কাজ নেই। আজ সাবাথ ডে
–আপনি কি খ্রীষ্টান?
হলে যেন খুশি হও তুমি!
–এই খবর্দার! আপনি আমাকে তুমি বলছেন যে!
–কেন, তুমি কি আমার গুরুজন?
অনুমতি না দিলে অনাত্মীয়া কোন মেয়েকে তুমি বলতে নেই তাও জানেন না?
–অনুমতি তো তুমি দিয়েছ?
–ঈস! কী মিথ্যুক আপনি! কবে অনুমতি দিলাম?
মুখে দাও নি, দিয়েছ তোমার চোখের তারায়, তোমার ঠোঁটের হাসিতে।
-ওঃ! কাব্য হচ্ছে বামুন-ঠাকুরের। নিন, উঠুন উঠুন। বেগুন গাছগুলোর তলায় আগাছা হয়েছে। নিড়িয়ে দিতে হবে। একা হাতে আমি কত পারি?
–আমি কি তোমার মুনিষ, পরাণ রুহিদাস?
না! পরাণ বল্লভ! উঠুন! বেগুন খাবার বেলায় তো চারখানা হাত বার হয় দেখি।
–তা তো বের হবেই। আমি হলাম হিন্দু তায় বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, চতুর্ভুজের উপাসক। তার মর্ম যবনী হয়ে তুমি কি বুঝবে?
নারায়ণ চার হাতে খান না ঠাকুরমশাই। নিন উঠুন!
অগত্যা উঠেই পড়তে হয়।
মুখহাত ধুয়ে ছোলা গুড় মুখে দিয়ে চন্দ্রভান নেমে আসে বেগুনের ক্ষেতে। ঊর্মিলা খুরপি নিয়ে তার আগেই এসেছে। রৌদ্রের তেজ এর মধ্যেই বেশ বেড়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে গেল তার মুখটা। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে! চন্দ্রভান বলে–এ গ্রামে তোমার কোন বান্ধবী নেই?
কেমন করে থাকবে বলুন? এখানে আমার বয়সী সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা সব শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেবেলায় যাদের চিনতাম এখন তারা সবাই খোকার মা! সমবয়সী আর যারা আছে এ গাঁয়ে, তারা মেয়ে নয়, এ গ্রামের বউ। তাদের গল্প আমার মত কুমারী মেয়ের সঙ্গে জমে না।
–কেন জমে না?
ঊর্মিলা মুখ তুলে আবার তাকায়। তারপর আবার মুখটা নিচু করে বেগুন গাছে গোড়া খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, একটা কথা বলবেন সত্যি করে?
-কী?
আপনি সত্যি কি? ফুল না নেভ?
তার মানে?
তারও মানে? থাক ও কথা!
চন্দ্রভান একটু ঘনিষ্ঠ হবার জন্য বলে–তোমার সঙ্গে আমার জীবনের খুব মিল। তাই নয় ঊর্মি।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। চন্দ্রভান অপ্রস্তুত হয়ে বলে, এর মধ্যে হাসির কি হল?
না, ভাবছিলাম, লা-টা কোন্ গাঙে ডুবে মল?
তার মানে?
-সব কথারই মানে? আমার নামের লা-টা কোথায় গেল মশাই!
চন্দ্রভানও উঠে দাঁড়ায়। ছায়ায় সরে এসে বলে, তোমার সঙ্গে কোন সিরিয়াস কথা বলা যাবে না।
–ও! সিরিয়াস কথা বলবেন বুঝি? তা আগে বলতে হয়। কী, বলুন? ঊর্মিলাও সরে আসে ছায়ায়। গম্ভীর হয়ে তাকায়। যেন ব্রতকথা শুনছে।
বলছিলাম কি, জানো, আমারও মা নেই!
সে তো জানিই আমি!
–তুমি কেমন করে জানলে?
-বাঃ, জানব না? আপনি এখানে কত তারিখে এসেছেন খেয়াল আছে? পয়লা কার্তিক। মা থাকলে কখনও ছেলেকে অগস্ত্য-যাত্রার দিন চাকরি করতে পাঠায়।
উঃ! আশ্চর্য মানুষ তুমি! এত বার ব্রত তিথি-নক্ষত্র–
–অর্থাৎ বলতে চাইছেন, কোন বামুন বাড়ির বউ হলেই আমাকে ঠিক মানায়, তাই না? কিন্তু সে গুড়ে বালি মশাই–মুর্গী ছাড়া
হঠাৎ ওর হাতখানা ধরে ফেলে চন্দ্রভান। উত্তেজনায় সে থর থর করে কেঁপে ওঠে, বলে–সে কথা তুমি আগেও বলেছ ঊর্মি, কিন্তু আমি যদি খ্রীষ্টান হয়ে যাই
ঊর্মিলা একটুও উত্তেজিত হয় নি, কিন্তু ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, পাগলামি করবেন না চন্দ্রভানবাবু!
ম্লান হয়ে যান চন্দ্রভান। বলে, পাগলামি? কী বলছ তুমি?
ঊর্মিলা জবাব দেয় না। ধীর পদে ফিরে যায় বাড়ির দিকে। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায় চন্দ্রভান। পথ রোধ করে, বলে কিন্তু জবাবটা তুমি দিয়ে যাও ঊর্মিলা!
জবাব তো দিয়েছি আমি। আপনি তাই যদি আশা করে থাকেন, তবে ভুল বুঝেছেন। আমি অন্যপূর্বা!
ধীর পদে সে চলে যায় টালি-ছাওয়া বাড়িটার দিকে। বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্রভান। না, এ হতে পারে না, এ অসম্ভব! এ ডাহা মিথ্যা কথা।
–সেইদিনই আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়ে গেল চন্দ্রভানবাবু। আমি অনুভব করিলাম, যত মত তত পথ!
ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে গিয়েছিলেন ফাদার আঁর শারদাঁ। সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছিলেন। ঠাকুর স্বয়ং সর্বধর্মের নির্যাস গ্রহণ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। খ্রীষ্টান ধর্মাচরণ করেছেন, সুফী ধর্মের মর্মকথা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, তন্ত্রসাধনা করেছেন, বৈষ্ণব ধর্মের রসে অবগাহন স্নান করেছেন। তারপর তিনি বুঝেছেন–যে কৃষ্ণ, সেই খ্রীষ্ট! সব পথ গিয়ে মিশেছে একই সঙ্গমে। তাই গিরীশ, নরেন, মথুরাবাবুকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা করতে বলেছিলেন। জানতেন, সবাই ফিরে আসবে একই সমের মাথায়। ফাদার শারদাঁ তার পথ খুঁজে নিয়েছেন। তিনি খ্রীষ্টান কিন্তু গোঁড়ামি নেই তার এক তিল!