কাহিনীর উপসংহারটি করুণ। জাক-লুই শারদাঁ আবার ফিরে গেছেন দেশে। ঊর্মিলার মা অবশ্য সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়েই মুক্তি পেয়েছিল। ঊর্মিলা সেই শিশুকাল থেকে ফাদার শারদাঁর সংসারে আছে। ফাদার শারদাঁ তাকে কলকাতার মিশনারী স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সেখানেই ছাত্রাবাসে থেকে পড়ে ঊর্মিলা। প্রতি ছুটিতে বাওয়ালীতে আসে।
কাহিনী শেষ করে বৃদ্ধ বলেছিলেন–এ সকল কথা যেন ওর সম্মুখে আলোচনা করিবেন না। অত্যন্ত অভিমানী মেয়ে। আর এখনও তো ও নিতান্ত ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ! হিন্দু সমাজে এমন পনের-ষোলো বছরের কচি খুকি থাকলে বাপ মায়ের গলা দিয়ে ভাত নামতো না। চন্দ্রভান আর কথা বাড়ায়নি।
.
–শুনছে গুরুমশাই! ছেলেদের আজ ছুটি দিয়ে দিন।
স্লেট থেকে মুখ তুলে চন্দ্রভান দেখতে পায় পাঠশালার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ঊর্মিলা। আজ আর ফ্রক নয়। পরেছে বাসন্তী রঙের একখানা ধনেখালি, গায়ে ঐ রঙের জ্যাকেট। স্নানান্তে পিঠের উপর মেলে দিয়েছে কোঁকড়া কোঁকড়া এলো চুল। কপালে পরেছে একটা লাল টিপ। ঠিক লক্ষ্মী ঠাকরুণটির মত লাগছে আজ ওকে।
–কেন? ছেলেদের হঠাৎ ছুটি দিয়ে দেব কেন?
–ন’পিসির জ্বর হয়েছে। মাথা তুলতে পারছে না। আজ আপনাকে রাঁধতে হবে।
চন্দ্রভান বিব্রত বোধ করে। আমতা আমতা করে বলে রাঁধতে হবে। আমি যে রান্নার কিছুই জানি না!
ফিক করে হেসে ফেলে ঊর্মিলা বলে–এটা কি রকম কথা হল রসুয়ে বামুনমশাই! এটা যে আপনার কুলকর্ম!
চন্দ্রভান গম্ভীর হয়ে বলে–আমি রসুয়ে বামুন নই। আমি রান্না করতে পারব না। ফলার খাব।
-ও আপনি বুঝি রসুয়ে বামুন নন, ফলারে বামুন! নিন, উঠুন উঠুন! আপনি না হয় ফলার করবেন–এতগুলো বাচ্চা খাবে কি?
রাখাল রুহিদাস সর্দার পোড়ো। সাহস করে বলে–তাহলে আমাদের ছুটি, মাশাই?
চন্দ্রভান কিছু বলার আগেই ঊর্মিলা ধমকে ওঠেনা, তোমার ছুটি নয়। কাঠগুলো চেলা করতে হবে। বাদবাকির ছুটি–যাও!
মাশায়ের নির্দেশের জন্য আর অপেক্ষা করল না ওরা। ছুটি-ছুটি-ছুটি চিৎকার করতে করতে দুর্দাড় করে বেরিয়ে গেল মাঠে।
চন্দ্রভান বইপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ে। বলেচলুন, রান্নাঘরে যাই!
বাঃ! কী বামনাই বুদ্ধি আপনার! ছত্রিশ জাতের ছেলেকে ছুঁয়েছেন, সে খেয়াল আছে? যান আগে স্নান করে আসুন!
চন্দ্রভান হেসে বলেজাত যায় আমার যাবে! আপনার কি?
–জাত খোয়াবার জন্য যেন বড় বেশি উৎসাহ দেখছি। নজরটা কোন দিকে?
চন্দ্রভান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে-মানে?
-মানে, একা আপনার জাতের কথা তো হচ্ছে না! ন’পিসির জন্যেও তত পথ্য বেঁধে দিতে হবে আপনাকে। সে বেচারী কেন জাত খোয়ায় আপনার গরজে
–আমারই বা গরজটা কি?
–তা আপনিই জানেন। কী উঠবেন, না বকবকই করবেন শুধু?
রান্নাঘরে এসে নানান বিড়ম্বনা। ঘরে ঢুকতে পারে না ঊর্মিলা। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধমক দেয়–ওটা কী হচ্ছে? নাড়ুন, নাড়ুন-তলাটা ধরে যাবে না? আঃ! বাঁ হাত দিয়ে ধরুন হাঁড়িটা! এই দেখ! শুধু হাতে ধরতে বলেছি নাকি? ন্যাকড়া দিয়ে তো ধরবেন? দেখি, দেখি-হাতটা পুড়ে গেল তো? আমারই হয়েছে যন্ত্রণা! এমন বামুনের জাতই যাওয়া উচিত!
চন্দ্রভান প্রতিবাদ করে না। নির্দেশ অনুযায়ী কাজগুলি করে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যা কিছু করতে যায় তাই কি ভুল? প্রতিপদেই ধমক খাচ্ছে বেচারি। আচ্ছা, নাড়তে বলেছি মানে কি ঘন্ট বানাতে বলেছি? ক্রমাগত অত নেড়ে চলেছেন কেন? আলুগুলো যে ঘেঁটে একশা হয়ে গেল। ওকি? হাতটা ধুয়ে নিন–এঁটো হল না?
চন্দ্রভান হঠাৎ ঘুরে বসে বলে-বামুনের সঙ্গেই আপনার বিয়ে হওয়া উচিত! এত এঁটোকাঁটার বিচার শিখলেন কোথায়?
খিলখিল্ করে হেসে ওঠে ঊর্মিলা, বলে– রক্ষে করুন। মুর্গীই খেতে পারব না সারা জীবনে।
–মুর্গী বুঝি আপনি খুব ভালবাসেন?
আপনি কি ভেবেছিলেন? আর কাউকে ভালবাসি? তাই বামুন বাড়িতে আমাকে চালান করতে চাইছিলেন?
উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রভান। এগিয়ে যায় দ্বারের দিকে এক পা।
–আপনার হাত এঁটো।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চন্দ্রভান। হাত দুটির দিকে তাকিয়ে দেখে।
-পুড়ে গেল যে ওদিকে! নামান নামান।
–পুড়ে গেল? কি পুড়ে গেল? নামাতে হবে? কাকে, কিসের থেকে?
.
গ্রামের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে চন্দ্রভানের। চরণ, মণ্ডল, নিতাই, রুহিদাস, জীবন কর্মকার আর গোপেন পাড়ুই। মাঝে মাঝে ওদের ওখানে গিয়ে আড্ডা মেরে আসে। ওরা ওকে ডাকে মাস্টারমশাই বলে। জমিদারমশাই একদিন স্কুল কেমন চলছে তা দেখতে এসেছিলেন। ওকে নিমন্ত্রণ করে গেলেন রাধাকান্তজীর প্রসাদ গ্রহণ করতে।
সেদিন ছিল রবিবার। ওদের স্কুলের ছুটি। ফাদার শারদাঁ সকাল বেলাতেই ঘোড়া নিয়ে চলে গেলেন কোন্ দূর গাঁয়ে। রোগী দেখতে। চন্দ্রভান আশ্রয় পেয়েছিল ঐ পাঠাশালা ঘরেই। মাটিতে সতরঞ্চি বিছিয়ে শুতে। মাথার কাছে একটি কলসি। নিজেকেই জল ভরে রাখতে হয় তাতে। সকালে উঠে বিছানা গুটিয়ে রাখে। তখন সেটা পড়াশুনার আসর। আজ ছুটির দিন। আজ একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা যেতে পারে। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে থাকে। এই চার মাসের ভিতর সে কলকাতার কোন চিঠি পায়নি। কোন চিঠি নিজেও লেখেনি কাউকে। ওর ঠিকানাই তো জানে না কেউ। আচ্ছা সূরয কেমন আছে? কলকাতাতেই আছে নিশ্চয়। এতদিনে হাফইয়ার্লি পরীক্ষা হয়ে গেছে। সামনেই ওর ছুটি। ছুটিতে নিশ্চয় সে পাগলচণ্ডী যাবে। এখানে সূরয এলে কী মজা হত! গগ্যাটা পাস করতে পারে নি। করবে কোথা থেকে? পড়াশুনা যে করত না একদম। বটুক ভর্তি হয়েছে বরিশাল কলেজে। আর দীপু? দ্বৈপায়ন? সে তো প্রেসিডেন্সির ছাত্র এখন! মস্ত পণ্ডিত হবে একদিন ওর বন্ধু দীপু।