দাদুকে দেখেই কিন্তু চিনতে পারলাম। কারণ মায়ের অ্যালবামে তার ফটো দেখেছি। পরিবর্তনের মধ্যে মাথার চুলগুলো বিলকুল সাদা হয়ে গেছে। বসেছিলেন একটা ক্যাম্বিসের ইজি-চেয়ারে। কী একখানা বই পড়ছিলেন। হাতে লাল-নীল পেন্সিল। আমি প্রণাম করতেই বললেন বসো। আর একখানা বই এনেছ?
আমি তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় বইখানি বাড়িয়ে ধরি।
প্রথম পাতাটা উল্টে দেখে বললেন–কই, আমাকে দিচ্ছ তা তো লিখে দাওনি?
কোন পত্রিকায় সমালোচনার জন্য দু’কপি বই দাখিল করতে হয় শুনেছি; কিন্তু–
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে কলম বার করে ওঁর নাম লিখে বইটি ওঁর হাতে দিলাম। বৃদ্ধও বিনা বাক্যব্যয়ে ইজি-চেয়ার থেকে উঠলেন। টেবিলের টানা ড্রয়ার থেকে মোটা একখানা বাঁধানো খাতা দেখে বইটাতে একটি নম্বর বসালেন। আলমারি খুলে একটা নির্দিষ্ট তাকে বইয়ের নম্বর মিলিয়ে সেটিকে রাখলেন এবং ব্রাউন কাগজে মোড়া একখানি বই নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার বই।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে বললেন, আমি বনফুলের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারিনি। একথা ঠিক যে, সাধারণ বাঙালী পাঠকের ক্ষীর হজম করার ক্ষমতা ক্রমশ লুপ্ত হতে বসেছে; আর দল বেঁধে ফুচকা খেতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তবু আমার বিশ্বাস–তোমার এ বই একদিন দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হবে। তখন এ কপিটা তোমার কাজে লাগবে।
বইটা খুলে দেখি–মার্জিনে অসংখ্য মন্তব্য! বর্ণাশুদ্ধি সংশোধন করেছেন, পাঞ্চয়েসন মার্ক বদলেছেন,–গোটা বইটা প্রুফ রীডিং করেছেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ। বেশ বোঝা যায় কী অপরিসীম পরিশ্রম করেছেন উনি বইটি পড়তে বসে। দু-এক স্থলে ওঁর সংশোধনের অর্থ বোধগম্য হল না। প্রশ্ন করলাম–লেঅনার্দোর ‘লাস্টসাপার’ কথাটা কেটেছেন কেন?
দ্বৈপায়ন-দাদুর চোখদুটি হাসিতে চিকচিক করে উঠল, বললেন, যেহেতু লেঅনার্দো দা ভিঞ্চি ‘লাস্ট সাপার’ নামে কোন ছবি আঁকেননি।
অবাক হয়ে বলি, তার মানে? ‘মোনালিসা’ ছাড়া ওঁর ‘লাস্ট সাপারই তো—
বাধা দিয়ে দাদু আবার বলেন, দেশ তো পাঁচিশ বছর স্বাধীন হয়েছে, নরেন। লেঅনার্দো যে ছবিটি এঁকেছিলেন তার নাম ‘লাস্ট সাপার’ তিনি দেননি। তাঁর ভাষায় যদি বল, তবে বলা উচিত ‘চেনা উলতিমা’ (Cena Ultima)। আর সে-ভাষায় যদি তোমার পাঠক অর্থ গ্রহণ করতে না পারে তবে যে ভাষায় বইটি লিখেছে সেই ভাষাতেই বল, ‘শেষ সায়মাশ’। ইংরাজের দেওয়া নাম এখনও চালাব কেন?
আমি সবিনয়ে ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে বলি, আর এখানে? সিংহল-অবদান জাতকের এখানে জিজ্ঞাসা চিহ্ন কেন?
দাদু বললেন, ঠিক মনে পড়ছে না। পড়ে শোনাও তো।
আমি পড়ে যাই-দ্বীপটির নাম তাম্রদ্বীপ–ইতিপূর্বে জম্বুদ্বীপের বণিক কখনও আসেনি এ দ্বীপে। নারিকেল-ছাওয়া সমুদ্র-মেখলা এই দ্বীপে–
দাদু বাধা দিয়ে বলেন, ও বুঝেছি। তোমার ও-বর্ণনায় আমার আপত্তি ‘নারিকেল ছাওয়া’ শব্দটায়। তুমি জাতকের গল্প শোনাচ্ছ–সিংহল দ্বীপে পলিনেশিয়া থেকে নারকেল আমদানি করা হয় খ্রীষ্টজন্মের পর। খ্রীষ্টপূর্ব সিংহলের বনরাজির বর্ণনায় ‘তমাল-তাল’ চলতে পারে। নারিকেল ওখানে আউট অফ বাউণ্ডস্!
কথা বলতে বলতে দুজনেই মেতে উঠি। আমি সদ্য অজন্তা চষে এসেছি। জাতীয় গ্রন্থাগারে না-হক মাস ছয়েক ঘোরাঘুরি করেছি–অথচ দ্বৈপায়ন-দাদু দেখছি আমার চেয়ে সব বিষয়েই খবর রাখেন বেশি। মতের অমিল হলেই বার করে আনছেন বই– গ্রিফিথ, ইয়াজদানি, লেডি হেরিংহ্যাম, মুকুল দে। টেবিলের ওপর স্তূপাকার হয়ে উঠল ঈশানচন্দ্রের জাতক, ফৌসবোলের জাচকাৰ্থ বৰ্ণনা, বুদ্ধের নানান জীবনী। কোন্ গ্রন্থটি কোন্ আলমারির কোন্ তাকে থাকে তা খুঁজে বার করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হচ্ছে না। দুজনেই ডুবে গেছি অজন্তাসমুদ্রে।
সকাল আটটায় শুরু হয়েছে। তারপর কখন যে ঘন্টা-চারেক কেটে গেছে একেবারেই টের পাইনি। হুঁশ হল সীমামাসি ডাকতে আসায়।
বাবা, তোমার স্নান করার সময় হল যে।
–এই যে সীমা এসেছিস! নরেনের জন্য একটু চা-টা—
–তুমি ছাড়লেই দিতে পারি।
–না না, চা খেতে খেতেই আমাদের চলতে পারে।
মনে পড়েছিল কাঁচি সিগারেটের সেই বিজ্ঞাপনটির কথা। আমি কী হারিয়েছি তা আমি নিজেই জানি না। বইটি লেখার পর ওঁর কাছে না এসে যদি লেখার আগে আসতাম!
সেদিন ওঁর স্নানের জল যে কবার ঠাণ্ডা হয়েছিল তা মনে নেই। তবে ছাড়া যখন পেলাম তখন বেলা দুটো।
কিন্তু ছাড়া কি সত্যিই পেলাম? এমন মানুষকে কি ছাড়া যায়? ত্রিশ বছরের লোকসানটা পুষিয়ে নিতে ঘন ঘনই আমাকে বাগবাজারমুখো ছুটতে হল। এখন বুঝতে পারি, কোন্ আকর্ষণে বাবা ওঁর কাছে আসতেন। দু’চার দিনেই বৃদ্ধ আপন করে নিলেন আমাকে। গিয়েছিলাম আলমারির লোভে কিন্তু এখন দেখছি আলমারির মালিকও কম লোভনীয় নন।
একদিন বললাম, আপনি লেখেননি কিছু? বই-টই?
বৃদ্ধ হাসলেন, পড়েই শেষ করতে পারলুম না-লিখি কখন?
-কখনই লেখেননি? প্রবন্ধ-টবন্ধ?
ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে কিছু লিখেছি। সে-যুগের মাসিক-সাপ্তাহিকে। বই করে ছাপাইনি কিছু।
–আপনার ছবির দিকে ঝোঁক হয় কতটুকু বয়সে?
বৃদ্ধ আবার হেসে বলেন, একেবারে ছেলে বয়স থেকেই। আমার ঠাকুরদা নিজে হাতে কালীপ্রতিমা বানিয়ে পুজো করতেন। তাঁর কাছ থেকে মাটি চুরি করে যখন পুতুল গড়তাম তখন মাজায় কড়িবাঁধা ঘুনসি-ছাড়া বোধহয় আর কিছু ছিল না।