একদিন চন্দ্রভান সাহস করে প্রশ্ন করে বসল–আচ্ছা, এই ছবিতে ঐ উলঙ্গ লোকগুলিকে আঁকা হয়েছে কেন?
ফাদার শারদাঁ তার বৈঠকখানায় গোলাকার ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলেন–ছবির ঐ বাপ-মা আর শিশু কে জানেন?
আজ্ঞে না। ওঁরা কে?
যোশেফ, মেরী এবং যীশু। এঁরা হলেন হোলী ফ্যামিলি। এ ছবিটি একটি বিখ্যাত তন্দো। তন্দো মানে গোলাকৃতি ছবি, আপনাদের যেমন লক্ষ্মীর সরা আর কি! এটা এঁকেছেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তাঁর নাম মিকেলাঞ্জেলো বুয়োনরতি। নামটা শুনিয়াছেন?
চন্দ্রভান আবার মাথা নেড়ে বলে না।
–ছবিটা মিকেলাঞ্জেলো এঁকেছিলেন একজন ইটালিয়ান কাউন্টের জন্য। তিনি পশ্চাৎপটের ঐ নগ্ন মানুষগুলিকে হোলি ফ্যামিলিতে দেখে সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বলেন, ছবিটি অশ্লীল। পরে তিনি মিকেলাঞ্জেলোর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন ও ছবিটিা কিনিয়া নেন। ঐ ছবি আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র। কেন তাহা বলি শুনুন।
মিকেলাঞ্জেলোর দোনি তন্দোর প্রসঙ্গে সেই যুগান্তকারী শিল্পগুরুর গোটা জীবনটাই শুনিয়েছিলেন তিনি। আর শুধু কি মিকেলাঞ্জেলো? ঐ প্রসঙ্গে রেনেসাঁ কি তা-ও বুঝিয়েছিলেন। রাফাইল, লিওনার্দো, জর্জনে, এল গ্রেকো, তিশান সবাই এসেছিলেন ভীড় করে সেই বাওয়ালী গ্রামের টালি ছাওয়া ঘরে। চিত্রকর থেকে চিত্রের প্রসঙ্গ। দেওয়াল থেকে ছবিগুলি পেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নানান তথ্য।
–আপনি চিত্রকরদের বিষয়ে এত কথা জানলেন কেমন করে?
–আমি যে চার্চে ছবি আঁকতাম।
–আপনি ছবি আঁকতে পারেন? কই দেখি আপনার ছবি!
বৃদ্ধ হেসে বলেছিলেন–আমি কাগজে ছবি আঁকি না। দেওয়ালে আঁকি। টেম্পারা ও ফ্রেসকো।
তারপর বলেন–আপনি দেখিতে ইচ্ছা করেন? আচ্ছা আসুন।
রেভারেণ্ড আঁর শারদাঁর শয়নকক্ষে সেই তার প্রথম পদার্পণ। মাটির দেওয়াল, খড়ের চালা। ঐ টালি-সেডের পিছনেই। ঢুকেই স্তম্ভিত হয়ে গেল চন্দ্রভান। ঘরের একপ্রান্তে মাটিতে পাতা একটি বিছানা। মাথার কাছে একটি কলসি। অপর প্রান্তে দেওয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। তার পায়ের কাছে আল্পনা আঁকা একটি মাটির ঘটে স্থলপদ্ম। আর ঘরের চতুর্দিকের দেওয়ালে প্রকাণ্ড বড় বড় অপূর্ব সব ছবি। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে। চুন, গিরিমাটি, হলুদ ও নীল রঙ গুলে জলরঙে আঁকা। মোটা মোটা রেখা। রঙ কোথাও গাঢ় থেকে হালকা করা হয় নি। এক এক রঙ এক এক জায়গা জুড়ে। অথচ সবটা মিলিয়ে ভারি হালকা একটি আমেজ।
–আপনি এত সুন্দর ছবি আঁকেন!
বৃদ্ধা হাসলেন শুধু।
–এটা কার ছবি? এঁর সারা গায়ে এমন তীর বেঁধা কেন? আর থামের সঙ্গে এঁকে অমন করে বেঁধে রেখেছে কেন?
উনি স্টিসেন্ট সিবেয়ান। আপনাকে ওঁর গল্প শুনাইব।
চন্দ্রভানের মনে পড়ে গেল তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ঠিক ঐ রকমভাবেই তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল সেদিন। সূরযভানের পিঠের উপর পড়া প্রতিটি কশাঘাত ঐভাবেই তীরের মত বিঁধেছিল তার বুকে।
–আর ইনি? এই মাথায় মুকুট-পরা মহিলাটি? ক্রুশ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি। ইনি কি মা-মেরী।
না। মাতা মেরীর মাথায় আমি মুকুট আঁকিব কেন? তিনি তো সামান্য মেহনতী-ঘরের বধূ–আর ক্রুশকাষ্ঠই বা কেন দিব তাঁর হাতে? উনি সেন্ট হেলেনা। সম্রাট কনস্টান্টাইন–যাঁর নামে কন্সড়ানটিনোপল শহর–উনি তাঁর মা। তিনিই প্রভু যীশুর ক্রুশকাষ্ঠটি খুঁজিয়া বাহির করেন।
চন্দ্রভান তন্ময় হয়ে ছবিগুলি দেখছিল। ওদের বাড়িতেও বড় বড় ছবি আছে। সেগুলি অধিকাংশই বিলাতী ঢঙে আঁকা নিরাবরণা অপ্সরা অথবা নিসর্গ চিত্র। কিছু আছে রবি বর্মার প্রিন্ট। এ ছবির জাত আলাদা। মোটা মোটা তুলির আঁচড়। মূর্তিগুলির যেন ভার নেই–যেন শূন্যে ভাসছেন তারা!
বললে–এমন অপূর্ব ছবি আপনি এমন কাঁচা দেওয়ালে এঁকেছেন? এ আর কদিন টিকবে?
ফাদার শারদাঁ ক্রুশলাঞ্ছিত নিজ বক্ষদেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন–এটাও যে কাঁচা দেওয়াল চন্দ্রভানবাবু। এটাই বা আর কতদিন টিকবে?
কিন্তু মিকেলাঞ্জেলোর দোনি তন্দো তো চারশ বছর টিকে আছে।
-ঠিক কথা। মিকেলাঞ্জেলো পৃথিবীর জন্য এঁকেছিলেন। তিনি ছিলেন শিল্পী। কিন্তু এ ছবির একজনই দর্শক। নেহাৎ আপনি আজ দেখিতে চাইলেন তাই আপনাকে দেখাইলাম।
চন্দ্রভান এ যুক্তি মেনে নিতে পারে না, কিন্তু প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতেও তার সঙ্কোচ হয়।
বৃদ্ধ বলেন–বাওয়ালী গ্রামের জমিদার মণ্ডলমশায়ের রাধাকান্ত মন্দিরের খিলানে পোড়া মাটির মূর্তিগুলি দেখেছেন চন্দ্রভানবাবু? তাও শিল্প হিসাবে অপূর্ব। মণ্ডলমশাই কাঁচা দেওয়ালে আঁকেন নাই। কিন্তু মহাকালের হিসাবে দু বছর আর দুশ বছরে কী প্রভেদ?
এবারও জবাব দেয় নি চন্দ্রভান।
ঊর্মিলার উপাখ্যানও শুনেছে শারদাঁর কাছে। মেয়েটি চন্দ্রভানের মত হতভাগ্য। বোধ করি তার চেয়েও বেশি। ঊর্মিলার বাবা জাক-লুই শারদাঁও একদিন ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন সুদূর ফরাসী দেশ থেকে এই ভারত ভূখণ্ডে। একটি কোম্পানীর ম্যানেজার হিসাবে। তখন তার উঠতি বয়স। এখানে এসে একটি বঙ্গললনাকে তার ভাল লেগে গেল। মেয়েটি সুন্দরী, গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের। কেমন করে পর্দানসীন একটি বঙ্গনারীর সঙ্গে ঊনবিংশ শতকের সেই শেষ পাদে একটি ফরাসী ভদ্রলোকের দেখাসাক্ষাৎ হত সে কথা আর বিস্তারিত বলেন নি ফাদার শারদাঁ, হয়তো সে নেপথ্যের ইতিহাস তার জানাও ছিল না। জেনেছিলেন তার ফলশ্রুতিটকু। তা ঐ ঊর্মিলা।