চন্দ্রভান মরমে মরে যায় । কিন্তু মরার তখনও বাকি ছিল তার। বৃদ্ধ ওর হাত দুটি ধরে বললেন–আমার ভ্রাতুষ্পুত্রীর প্রগলভতার জন্য আমি মার্জনা ভিক্ষা করিতেছি।
.
বাওয়ালী গাঁয়ে চন্দ্রভান ছিল প্রায় এক বছর। এসেছিল কার্তিকের প্রথমে, ফিরে আসে পরের বছর অঘ্রাণের শেষাশেষি। এর মধ্যেই বাওয়ালী গ্রামটিকে ও ভালবেসে ফেলেছিল। ফাদার অঁরি শারদাঁ তার অন্তরে একটি স্থায়ী শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এমন গভীরভাবে সে আর কোনও মানুষকে শ্রদ্ধা করবার সুযোগ পায় নি। গুরু বলতে যা বোঝায় যিনি জ্ঞানাঞ্জনশলাকা পরিয়ে দেন, মুক্তি পথের ইঙ্গিত যিনি দিতে পারেন-রেভারেণ্ড অঁরি শারদাঁ ছিলেন তাই। অদ্ভুত মানুষ। শ্রদ্ধায় আপনিই মাথা নত হয়ে আসে। একদিনে চন্দ্রভান সব কথা জানতে পারেনি। জেনেছিল ক্রমে ক্রমে।
রেভারেণ্ড আঁরি শারদাঁ ছিলেন মেথডিস্ট চার্চের পাদরি। অল্প বয়সেই তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। বিবাহ করেন নি। প্রথমে ছিলেন ইটালিতে-রোমে। তারপর এসেছিলেন ভারতবর্ষে। খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারের ব্রত নিয়ে। চার্চ সম্প্রদায় থেকেই ওঁর পাথেয় দেওয়া হয়। প্রথমে এসে ওঠেন পণ্ডিচেরীতে, পরে ফরাসী চন্দননগরে। বাঙলাদেশে এসে এক নতুন ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় হল তার। আলাপ হল কেশবচন্দ্রের সঙ্গে, ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে। তর্ক করলেন এঁদের সঙ্গে; ভাব বিনিময় হল। তারপর দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এক অদ্ভুত ভাবুকের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। কেমন যেন বদলে যেতে থাকে আজন্মের ধ্যান ধারণা। অনশনক্লিষ্ট নিরন্ন হিদেনগুলোকে নানাভাবে প্রলোভিত করে চার্চের ছত্রচ্ছায়ায় টেনে আনার মধ্যেই যে পরমার্থ আছে এ বিশ্বাসটাতেই ফাটল ধরল। ওঁর চালচলন ভাল লাগল না কর্তৃপক্ষের। ওঁকে হুঁসিয়ার করে দেওয়া হল। তবু আঁরি শারদাঁ সাবধান হতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হলেন তিনি। উনি নাকি হিন্দু হয়ে গেছেন। ফাদার শারদাঁ প্রতিবাদ করেননি। ওদের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন একদিন। বেছে নিয়েছিলেন এই অবোসীর জীবন। না, ধর্ম তিনি ত্যাগ করেন নি। মনে প্রাণে আজও তিনি নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান। এ গ্রামে যখন প্রথম এসে উঠেছিলেন তখন নানা দিক থেকে বাধা উপস্থিত হয়েছিল। হিন্দুসমাজ এবং জমিদার লাগল তার পিছনে। কিন্তু ক্রমে সকলের হৃদয়ই জয় করে নিলেন তিনি। ওরা দেখল, এ পাদরি সাহেব গাঁয়ে কোন চার্চ বানাতে চাইল না, একটি মানুষকেও খ্রীষ্টান করল না। বরং এসে যোগ দিল ওদের চণ্ডীমণ্ডপের সংকীর্তনে, ওদের দোল-দুর্গোৎসবে। একে একে ভয় ভাঙলো গ্রামের লোকের। পাগলাসাহেবের মতিগতি বোঝা ভার। গাজনের আসরেও তাকে দেখা যায়, দোলের দিনে আবীরও মাখায়, আবার শোনা যায় নাকি আপন মনে পিয়ানো বাজিয়ে ধর্মসঙ্গীতও গায়। সবচেয়ে বড় কথা পাগলা সাহেব ছিল ধন্বন্তরী ডাক্তার। কোথায় কার অসুখ করেছে কাকের মুখে বার্তা পেয়ে সে ছোটে। ভিজিট নেয় না, ওষুধের দাম নেয় না সারিয়ে তোলে! এমন মানুষকে কি আপন না করে পারা যায়।
পাগলা-সাহেব ধুয়ো ধরল সে একটি অনাথ আশ্রম খুলবে। যেসব অনাথ ছেলেমেয়ে বেওয়ারিশভাবে পথে বেপথে ভিক্ষা করে ফেরে, বাপ-মায়ের অবাঞ্ছিত সন্তান যারা সমাজে পরিত্যক্ত, তাদের সে বাঁচবার সুযোগ দিতে চায়। কথাটা বেয়াড়া; কিন্তু তাতে সায় দিলেন স্থানীয় জমিদার মশাই। নিজ ব্যয়ে তৈরী করে দিলেন খান দুই চালাঘর। পাগলা-সাহেব নিয়ে এসে তুলল গ্রাম-গ্রামান্তরের ঐ সব বেওয়ারিশ বাচ্চাদের। অথচ আশ্চর্য, জাত মারল না কারও। খ্রীষ্টানের ছোঁওয়া পর্যন্ত খেতে হল না তাদের। কোন্ বিধবা বামুনবুড়িকে এনে তুলল তার অনাথ আশ্রমে। তিনি সকলের ন’পিসি। কোথাকার কার ন’পিসি তা কে-ই বা জানে? বড়পিসি-মেজপিসি কেউ কখনও ছিলেন কিনা তাও জানা যায় না। বৃদ্ধা পিসি ওদের দায়িত্ব নিল। তিনকুল খাওয়া এই বিধবা বুড়ি এসেছিল ভাত কাপড়ের লোভে; কিন্তু ঐ অনাথ শিশুগুলিকে পালন করবার মধ্যেই বালবিধবার বঞ্চিত মাতৃত্ব তৃপ্ত হয়েছে। ঐ অপোগণ্ডগুলিকে সেও ভালবেসে ফেলেছে।
–আপনি আর খ্রীষ্ট ধর্ম দীক্ষা দেন না কাউকে?- প্রশ্ন করেছিল চন্দ্রভান।
না। আমার সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
–আপনি রোজ বাইবেল পড়েন?
পড়ি। মহাভারতও পড়ি। রামায়ণও পড়ি। কোরাণের কোন অনুবাদ পাই নাই। পাইলে তাও পড়িতাম।
–আপনি আমাকে বাইবেল পড়ে শোনাবেন? বুঝিয়ে দেবেন?
সানন্দে; কিন্তু বিনিময়ে আপনি আমাকে গীতা পড়িয়া শুনাইবেন। বুঝাইয়া দিবেন। আপনি তো ব্রাহ্মণ।
এমনিভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের ভাবের আদান-প্রদান। আঠারো বছরের চন্দ্রভান আর আটষট্টি বছরের শারদাঁর বন্ধুত্ব। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ওখানেই ব্রজরাখালের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। উনি জানতেন, ব্রজরাখালের একটি যুবক সমিতি আছে। তাই তার কাছেই খবর পাঠিয়েছিলেন। গুটি আট-দশ বাচ্চাকে আশ্রয় দিয়েছেন; কিন্তু তাদের লেখাপড়া শেখাবার একটা ব্যবস্থা না হলে যে ওরা মানুষ হয়ে উঠবে না। এতদিনে চন্দ্রভান আসায় বৃদ্ধের মনোবা চরিতার্থ হয়েছে। চন্দ্রভান তাদের পড়ানোর ভার নিয়েছে। সাতটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের। রোজ সকালে ওদের নিয়ে বসে। মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের বর্ণপরিচয় নিয়ে। আর ধারাপাতের নামতা মুখস্থ করায়। একটারও অক্ষর পরিচয় নেই। সন্ধ্যাবেলা সাহেব নিজেই এসে বসেন। মুখে মুখে নানান দেশ বিদেশের গল্প বলেন। তত্ত্বকথা শেখান।