তাই হবে।
হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মেয়েটি। এর মধ্যে হাসির কি আছে? আবার হঠাৎই হাসি থামিয়ে বলে একটু বসুন, একটা আলো নিয়ে আসি।
উঠে যায় ভিতরে। একটু পরেই আসে ডোন-দেওয়া একটা কেরোসিনের বাতি নিয়ে। রাখে সেটা মাটিতে। বাইরে এতক্ষণে ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। গোধূলির আলো সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। ঝোপে ঝাড়ে জ্বলছে মুঠো মুঠো জোনাকি।
মেয়েটি নিজে থেকেই বলে–আমার নাম ঊর্মিলা–
–ঊর্মিলা কী? চার্ডিন না শারদাঁ?
চার্ডিন।
–ও! আমার নাম শ্রীচন্দ্রভান গর্গ।
–গর্গ? আপনারা কি কায়স্থ?
–না, ব্রাহ্মণ।
–ও! তাহলে আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
চন্দ্রভান ওর কথামত বিছানা আর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে পিছন পিছন এগিয়ে যায়। মেয়েটি ওকে নিয়ে যায় বাড়ির পিছন দিকে কুয়োতলায়। বলে ঐ দড়িবালতি রয়েছে, এক বালতি জল তুলুন।
জল কি হবে?
–আপনি মুখ-হাত ধোবেন। খাবেন। বামুন মানুষ আমার তোলা জল তো আর আপনি খাবেন না। ঐ ঘটি রেখেছি, এক ঘটি জল নিয়ে আসুন।
চন্দ্রভান আর দ্বিরুক্তি করে না। কুয়োর জলে ভাল করে মুখ-হাত ধুয়ে নেয়। ঘটিটা মেজে এক ঘটি জল নিয়ে ফিরে এসে দেখে–মেটে দাওয়ায় একটি পশমের আসন বিছানো রয়েছে। সামনে একটি পদ্মপাতায় কয়েক টুকরো কাটা পেঁপে, শসা, কলা আর বাতাসা।
–আপনি খাবেন তো?–সৌজন্য বোধে প্রশ্ন করে চন্দ্রভান।
–আমি কি ফলারে বামুন?
ক্ষিধে পেয়েছিল প্রচণ্ড। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি। চন্দ্রভান বসে পড়ে বিনা বাক্যব্যয়ে। মনে হয় মেয়েটি মুখরা। অমন সুন্দর দেখতে, অথচ কথাগুলো কেমন যেন খোঁচা খোঁচা!
মেয়েটি আকাশের দিকে মুখ করে একটি স্বগতোক্তি করে ব্রজরাখালবাবুর যেমন কাণ্ড! ফলারে বামুন পাঠাতে কে বলেছিল!
চন্দ্রভানের রীতিমত রাগ হয়ে যায়। এ মেয়েটির মোড়লি করার কি আছে? কলাটা কোনক্রমে গলাধঃকরণ করে বলে–তাতে আপনার কি?
না, আমার আর কি? আমার তো হাঙ্গামা কমলই। আপনাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে না।
ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে উঠবার আগেই শোনা গেল অশ্বখুরধ্বনি। সাহেবরা নিশ্চয় ফিরে এলেন হাট থেকে। খাওয়া হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রভানের। উঠে পড়ে মুখটা ধুয়ে নেয়।
দুজন নয়, একজনই এলেন ঘোড়ায় চেপে! ঘোড়াটা এসে থামল একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায়। সাহেব নামলেন ঘোড়া থেকে। সঙ্গে ছিল ওষুধের একটা ব্যাগ। সেটা ঊর্মিলার হাতে দিলেন। সাদা আলখাল্লার মত একটা জোব্বা পরা, সাদা দাড়ি, চুলগুলি সাদা বাবরি চুলের গোছা কাঁধের উপর পড়েছে। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসু নেত্রে চন্দ্রভানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। চন্দ্রভানকে পরিচয় দিতে হল না। ঊর্মিলা বললে ইনি মিস্টার চন্দ্রভান গর্গ। ব্রজরাখালবাবু পাঠিয়েছেন।
বৃদ্ধ তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–আমি দুঃখিত। অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে বসিয়ে রাখিয়াছি।
চন্দ্রভান বৃদ্ধের প্রসারিত করটি গ্রহণ করে, সশ্রদ্ধ অভিবাদন করে বলে–আমাকে আপনি তুমি বলেই কথা বলবেন।
বৃদ্ধ হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠেন–বলেন–আমাকে মার্জনা করতে হবে চন্দ্রভানবাবু। বাঙলা ভাষায় ঐ আপনি-তুমি-তুই–এ আমার কিছুতেই অভ্যাস হইল না। ক্রিয়াপদগুলিও ঐ সঙ্গে বদল হয়ে যায় কিনা। আমি ঐ একটিই অভ্যাস করেছি। তাই সকলকেই আপনি বলি।
আপনার মেয়েকেও?
–কার কথা বলিতেছেন আপনি?
ঊর্মিলা আগ বাড়িয়ে বলে–উনি বোধহয় আমাকে–মীন করছেন।
-ওঃ না! ও আমার মেয়ে নয়, আমার…আমার…
–ভাইঝি, ভ্রাতুষ্পুত্রী। পাদ পূরণ করে ঊর্মিলা।
–এক্সাক্টলি! ভ্রাতুষ্পুত্রী। যাই হোক আসুন, ভিতরে বসা যাক।
ওরা ঘরের ভিতরে এসে বসে। মাটির দেওয়াল, মাটির মেজে। কিন্তু সমস্তটা ঝকঝক্ তকতক্ করছে। ঘরের দেওয়ালে এ গ্রামের সঙ্গে নিতান্ত বেমানান খানকতক ছবি। বেশ বড় মাপের। রঙিন ছবি। চন্দ্রভান চেনে না, তাই বুঝতে পারে না এগুলি পশ্চিমের বিখ্যাত চিত্রকরদের প্রিন্ট। করেজজোর কিউপিডের শিক্ষা, লিওনার্দোর শিলাসীনা কুমারী, রাফাইলের আকাদেমী, এল গ্রেকোর সেন্ট মার্টিন ও ভিখারী, রেমব্রান্টের রাতের পাহারা, গেনসবরার ব্লু বয়।
ঘরের একপ্রান্তে মাটি দিয়ে তৈরী একটি তুলসীমঞ্চের বেদীর মত। তার উপর একটি মূর্তি। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর। তার উপরে লক্ষ্মীর সরার মত গোলাকৃতি আর একটি রঙিন ছবি। একটি সুখী পরিবারের। বাপ, মা ও শিশুপুত্রের। বাপ সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, মা তার ডান হাতটা তুলে কাঁধের উপর বসা শিশুটিকে আকর্ষণ করছে। পশ্চাৎপটে কয়েকজন উলঙ্গ লোক। ওরা কেন এমন প্রকাশ্য স্থানে উলঙ্গ হয়ে সারি সারি বসে আছে বোঝা গেল না।
তিনজনে আসন গ্রহণ করলে বৃদ্ধ ঊর্মিলাকে ইংরাজিতে বললেন-মিষ্টার গর্গের জন্য কিছু খাবার-টাবার—
বাধা দিয়ে চন্দ্রভান বলে–উনি আগেই সেটা সেরেছেন। আমার আহার হয়েছে; কিন্ত একটা কথা। ফাদার আঁর শারদাঁ আজ সন্ধ্যেবেলায় এখানে আসবেন শুনেছিলাম
বৃদ্ধ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকান। হঠাৎ একটা খুক খুক শব্দ শুনে পাশে ফিরে দেখেন ঊর্মিলা প্রাণপণে হাসি চেপে বসে আছে। বৃদ্ধ একটু সামলে নিয়ে বলেন আমিই অঁরি শারদাঁ!
চন্দ্রভান নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়–ওঃ মাপ করবেন! আমি ভেবেছিলাম আপনি হেনরি চার্ডিন!
আর নিজেকে সামলাতে পারল না মেয়েটি। উচ্ছ্বসিত হাসির বন্যায় ফেটে পড়ল আর তৎক্ষণাৎ ছুটে পালিয়ে গেল ভিতরে। বৃদ্ধ যেন অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করছেন। কুণ্ঠিত হয়ে আমতা আমতা করে বলেন–আপনি ভুল করিতেছেন চন্দ্রভানবাবু। আমার নাম ফরাসী উচ্চারণে অঁরি শারদা। রোমান হরফে ওটা Henry Chardin।