এ তল্লাটে একজনই সাহেব। খুঁজে নিতে বেগ পেতে হল না। ব্রজরাখালও তাই বলেছিল–দশ বিশ মাইলের মধ্যে ঐ একজনই সাদাচামড়ার লোক আছেন। বাড়ি খুঁজে নিতে কোন অসুবিধা হবে না।
সাহেববাড়ির দোরগোড়ায় যখন এসে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মাটির দেওয়াল, টালির ছাদ, বারান্দার খুঁটিগুলো তালের। সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। মৌসুমী ফুলের চারা। ফুল ফুটেছে হরেক রকম। অচেনা সব বিলিতি ফুল। সব কখানা বাড়ি একটি প্রকাণ্ড বেড়া দিয়ে ঘেরা। পিছন দিকে হেঁচা-বেড়া এবং ফণীমনসার ঝোঁপ, শুধু সামনেটা মেদি পাতার সুন্দর করে ছাঁটা বেড়া। প্রবেশ পথে একটি কাঠের গেট। গেটের গায়ে একটা কাঠের ফলক। তার লেখাটা পড়ে ঘাবড়ে যায় চন্দ্রভান। কাঠের ফলকটাতে ইংরাজি হরফে লেখা আছে Rev. Henry Chardin। সর্বনাশ! ফাদার আঁর শারদাঁর বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এ কোন রেভ. হেনরি চার্ডিন-এর বাড়ি এসে উপস্থিত হল সে? কিন্তু গাঁয়ের মানুষদের আর দোষ দিয়ে কি হবে? সাহেব বলতে তারা এই একজনকেই চেনে। সাহেবের নাম আর কে মুখস্থ রাখে? সাহেব সাহেব। কিন্তু ঐ চার্ডিন সাহেব কোন্ বুদ্ধিতে এই অজ পাড়াগাঁয়ে নিজের বাড়ির ফটকে ইংরাজি হরফে নামটা লিখেছেন? তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ বা ওটা পড়েছে কখনও?
কাকে খুঁজছেন?
বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায় চন্দ্রভান।
তার কাছ থেকে হাত দশেক দূরে, বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। বয়স কত হবে ওর? বড় জোর পনের! টকটকে ফর্সা রঙ। কলকাতার ফিরিঙ্গি পাড়ায় এমন দুধে-আলতা রঙ, এমন নীল চোখ অথবা এমন সোনালী চুল কিছু অবাক করা দৃশ্য নয়-কিন্তু আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা এই বিজন প্রান্তরে অমন মেয়ের আবির্ভাবে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। মেয়েটিকে মেমসাহেবের মত দেখতে হলে কি হয়, ও কথা বলছে পরিষ্কার বাঙলায় কাকে খুঁজছেন আপনি?
–এটা রিক রেভ. হেনরি চার্ডিনের বাড়ি?
মেয়েটি মুখ টিপে হাসল। দুহাত মাজায় রেখে মাথাটি কাত করে বললে–আপনি বুঝি ইংরাজি পড়তে পারেন?
চন্দ্রভান থতমত খেয়ে যায়।
–এতক্ষণ বানান করে কি পড়লেন তাহলে?
চন্দ্রভান বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। এটা নেহাৎ বোকার মত প্রশ্ন করছে সে। বাড়ির দোরেই তো গৃহস্বামী নিজ পরিচয় ঘোষণা করে রেখেছেন। তারপর আর এ বাহুল্য প্রশ্ন কেন? সামলে নিয়ে বলে–ভারি মুশকিলে পড়লাম তো! এতক্ষণ খুঁজে খুঁজে এই ভর সন্ধ্যে বেলায় শেষমেশ ভুল ঠিকানায় এসে পৌচেছি। আচ্ছা এখানে আর কোন সাহেব বাড়ি আছে?
আপনি কাকে খুঁজছেন তাই তো বলছেন না!
-আমি খুঁজছি ফাদার আঁরি শারদাঁকে। শুনেছি তিনি বাওয়ালী গ্রামেই থাকেন। আচ্ছা, এটাই বাওয়ালী তো?
কলকাতা থেকে আসছেন বুঝি?
–হ্যাঁ। এখন এই ভর সন্ধ্যে বেলায়
-তাই তো! এখনই এসব জঙ্গলে শেয়াল বের হবে। ওরা আবার কলকাতার মানুষ দেখলেই খ্যাঁক করে তেড়ে আসে। আসুন, ভিতরে আসুন।
চন্দ্রভান কলকাতার ছেলে নয়। গ্রামের অভিজ্ঞতা তার আছে। মেয়েটিকে বেশ ফাজিল বলেই মনে হল। কিন্তু ওর মনের অবস্থা তখন উপযুক্ত জবাব দেবার মত নয়। খোলা গেট পেয়েও ঢুকবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না।
–এটা রেভ. হেনরি চার্ডিনের বাড়ি বটে, তবে এখানে আজ সন্ধ্যেবেলায় ফাদার আঁরি শারদাঁ আসবেন। আসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন সঙের মত?
ও! শারদাঁসাহেব আজ এখানে আসবেন? তবে তো ভালই হল।
মেয়েটি ওকে নিয়ে আসে ভিতরে। লাল সুরকি বিছানো পথটা দিয়ে টালি-ছাওয়া বাড়ির দাওয়ায়। ভিতর থেকে দুটি বেতের মোড়া বার করে আনে। একটি বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। একটিতে নিজে বসে পড়ে।
একটি জনমজুর শ্রেণীর লোক এসে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। বলে–আজ চলি দিদিমণি। কাল আসব তো?
-হ্যাঁ, আসবে বইকি। আর পরাণকেও নিয়ে এস। আলুগুলো কালকেই বসিয়ে দেব।
লোকটা কুণ্ঠিতভাবে বলে–ঘরে মালক্ষ্মী একেবারে বাড়ন্ত দিদিমণি–
–ও, আচ্ছা নিয়ে যাও।
মেয়েটি উঠে যায় ভিতরে। একটু পরেই নিয়ে আসে ছোট একটি বেতের টুকরিতে করে কিছু ধান। ঢেলে দেয় লোকটার প্রসারিত গামছায়। পেন্নাম সেরে লোকটা চলে যেতেই পরিবেশটা একেবারে নির্জন হয়ে পড়ে।
এমন জনমানবহীন বিজন প্রান্তরে একটি উদ্ভিন্ন-যৌবনা মেমসাহেবের সঙ্গে একান্তে চুপচাপ বসে থাকতে রীতিমত অস্বোয়াস্তি বোধ করে চন্দ্রভান। মেয়েটি শাড়ি-জ্যাকেট পরে নি, পরেছে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা ফ্রক-জাতীয় একটি পোশাক। তাই ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে আরও সঙ্কোচ হয়। বুকের উপর আঁচল না থাকলে কি এই বয়সী মেয়েদের দিকে তাকাতে পারা যায়? এতক্ষণে গোধূলির আলোও ক্রমে স্নান হয়ে যেতে বসেছে। চারদিক থেকে কেমন যেন একটা রহস্য-ঘন অন্ধকার ওদের ঘিরে। ধরছে। গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই অস্তেবাসী কুটিরগুলি। গ্রামের মানুষজনের। সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখান থেকে। বিশ্বচরাচরে যেন আর কেউ নেই, আর কিছু নেই। আছে মুখোমুখি বসা ওরা দুজন।
অস্বোয়াস্থিকর নীরবতা ভেঙে চন্দ্রভান বলে–চার্ডিন সাহেব কোথায় গেছেন?
গোবিন্দপুরের হাটে। এখনই এসে পড়বেন। আপনি ব্রজরাখালবাবুর কাছ থেকে আসছেন তো?
–আপনি কেমন করে জানলেন? কে বলেছেন? শারদাঁ সাহেব?
মেয়েটি তার ফ্রকের প্রান্ত থেকে চোরকাঁটা ছাড়তে ছাড়াতে মুখ নিচু করে বললে না, চার্ডিন সাহেবও তাহলে নিশ্চয় সেটা ওই শারদাঁ সাহেবের কাছে শুনেছেন।