একটু থেমে আবার বলেন–দেখ, যদি কোন কুণ্ঠা থাকে তবে খোলাখুলি বল।
চন্দ্রভান দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলে–আমারই ভুল বড়দা। আমি যাব।
–ব্যস্ ব্যস্। তবে আর দেরি নয়। এখনই রওনা হলে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছবে।
সুশীল সেন চট করে বলে-বড়দা, আমার মনে হচ্ছে উনি একেবারে একবস্ত্রে বেরিয়ে এসেছেন–
-তাই নাকি? তা হোক। আমি আজই মাইনে পেয়েছি
হাত পেতে ভিক্ষা কখনও নিতে হয় নি। চন্দ্রভান কিছুতেই হাতটা পাততে পারে না।
সুশীল যেন বুঝতে পারে ওর অবস্থা। বলে, কাল আংটিটা ওভাবে খোয়া না গেলে আজ তোমার এ অবস্থা হত না চন্দরদা–
–আংটি খোয়া গেছে? কেমন করে?
সুশীল হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দেয়। ব্রজরাখাল বুঝতে পারে, সম্ভ্রান্ত জমিদার ঘরের এ ছেলেটি লজ্জায় হাত পাততে পারছে না। তাই কদমের হাতেই টাকা কটা ফেলে দিয়ে বলে কদম, তুমিই বরং ওকে দিও, ধুতি-টুতি যা লাগবে। আচ্ছা দেখ তো, আমাদের দরিদ্র ভাণ্ডারের তহবিলে কিছু আছে? ফাদার শারদাঁর কাছে খানকতক বর্ণ-পরিচয় আর শ্লেট-পেনসিল ইত্যাদি পাঠিয়ে দিতে পারলে ভাল হত।
কদমকেশর লক্ষ্মীর ঘটটি উপুড় করে দেখিয়ে দেয়। ভাঁড়ে ভবানী!
তবে থাক। এর পরে না হয় দেখা যাবে। তাহলে চন্দ্রভানবাবু—
চন্দ্রভান বললে–আপনি কদমদাকে নাম ধরে ডাকেন। আমাকেও নাম ধরেই ডাকবেন, আমি ওঁর চেয়ে বয়সে ছোট
–তা বেশ তো! তাই না হয় ডাকব এবার থেকে।
চন্দ্রভান উঠে দাঁড়ায়। কদমকেশর একখানা রুলটানা খাতা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে–এখানে একটা সই করতে হবে।
চন্দ্রভান সই করবার জন্য কলমদানি থেকে কলমটা তুলে নিতেই হাঁ হাঁ করে বাধা দেয় ব্রজরাখাল। বলে–অমন কাজও কর না চন্দ্রভানবাবু। না পড়ে কোন কাগজে কখনও সই কর না। আগে পড়ে দেখ–
চন্দ্রভান বলে–পড়ে আর কি দেখব বড়দা? আপনারা দেশের ভাল করতে চান, নিয়মাবলী সেই ভাবেই করেছেন। ও আর দেখার কি আছে?
এ কথাটা ঠিক হল না চন্দ্রভানবাবু। কী প্রতিজ্ঞা করছ, কী কথা দিচ্ছ
চন্দ্রভান হেসে বলে, কথা দেওয়ার আর মূল্য কি বড়দা? এই তো একটু আগে আপনি আমাকে কথা দিলেন, আমাকে নাম ধরে ডাকবেন–অথচ এখনও বলছেন চন্দ্রভানবাবু!
দিলখোলা হাসি হাসল ব্রজরাখাল। বললে–আচ্ছা ভাই চন্দ্রভান, এবার থেকে তোমাকে নাম ধরেই ডাকব। কথার খেলাপ করব না।
নৌকায় গিয়েছিল চন্দ্রভান। আর বাড়িমুখো হয় নি। এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছিল সংসার থেকে। এ দুনিয়ায় এখন থেকে সে একা। সূরয বড় হোক, মানুষ হোক। তারপর তার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। যখন সূরয নিজের ইচ্ছায় পা ফেলতে পারবে। চন্দ্রভান বুঝতে পেরেছে কাকার আসল রাগ চন্দ্রভানের উপর। তার জন্যেই সূরযকে মার খেতে হয়েছে। ইচ্ছে করেই কাকা ওকে বেত মারে নি, কারণ অত্যাচারী বুঝেছিল নিজের পিঠের চেয়ে সূরযের পিঠেই চাবুকের আঘাত বেশি করে বাজবে চন্দ্রভানের। তাই ওর এ সিদ্ধান্ত। ও বুঝেছে, সংসার থেকে সরে না এলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়বে সূরযের উপর।
মেটিয়াবুরুজের ঘাটে দক্ষিণগামী একটি নৌকায় ঠাঁই পেয়েছিল। বজবজ পার হয়ে রাজারামপুরের ঘাটে যখন নামল তখন পড়ন্ত বেলা। ওখান থেকে বাওয়ালী নাকি মাইল তিনেক। মাঝি দেখিয়ে দিল রাস্তাটা সিধে দক্ষিণমুখো।
আম কাঁঠালের বাগান। তার মাঝখান দিয়ে পথ। দু-পাশে আশশ্যাওড়া আর বন ধোঁধলের আগাছা। মাঝে মাঝে মজা পুকুর, পড়ো ভিটে। বাঁশের ঝাড় নুয়ে পড়েছে পথের উপর। সরু পথটা একটু পরে গিয়ে মিশেছে দিগন্ত অনুসারী সবুজ ধানের ক্ষেতে। কার্তিকের প্রথম। ধানগাছের এবার রঙ ফেরানোর পালা। সবুজ থেকে সোনালী। ধানগাছের তলায় এখন জমে আছে থকথকে কাদা আর গেরুয়া ঘোলাজল। আর সেই ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কুমারী মেয়ের সিঁথির মত একফালি আলপথ চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। ঐ পথে যেতে হবে তাকে। একেবারে দিগন্তের কাছে দেখা যাচ্ছে গ্রাম্য জনপদ–আম কাঁঠাল-নারকেল ছাওয়া।
প্রায় ঘন্টাখানেক টানা হেঁটে ও এসে পৌঁছলো গ্রাম প্রান্তে। গ্রাম-সীমানায় মস্ত একটা তেঁতুলগাছ। তার তলায় খানকতক চালাঘর। সামনে একটা গো-গাড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওপাশের একটা ভাঙা জমিতে কতকগুলো উলঙ্গ ছেলে কপাডি খেলছে। ভিনদেশী মানুষকে আসতে দেখে সামনের চালাঘর থেকে একজন বুড়োমতন মানুষ হেঁকে ওঠে–কে যায়?
আদুল গা, পরনে ময়লা একটা খাটো ধুতি। হাতে হুঁকা। ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধ পড়ন্ত রৌদ্র থেকে দৃষ্টিটা আড়াল করতে চোখের উপর তুলেছে একখানা হাত।
চন্দ্রভান এগিয়ে এসে বলে–আমি শহর কলকাতা থেকে আসছি। বাওয়ালী যাব। ফাদার অঁরি শারদাঁর বাড়ি। পথটা বলতে পারেন?
–এটাই বাউলী। কি নাম তোমার? কি জাতি?
আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীচন্দ্রভান গর্গ। আমরা ব্রাহ্মণ।
–পেন্নাম হই। তা সাহেবের বাড়ি যাবেন? এই সড়ক ধরে সিধে চলে যান। এট্টু এগুয়েই দেখবেন রথতলা। সেখানে ডানবাগে মোড় ফিরবেন। গাঁয়ের একেবারে শেষ সীমানায় সাহেবের কুঠি।
চন্দ্রভান লক্ষ্য করে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেওয়ামাত্র বৃদ্ধ তাকে তুমি ছেড়ে আপনিতে উন্নীত করেছেন। কথা না বাড়িয়ে সে এগিয়ে যায়।
এককালে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। রথতলায় হোগলা দিয়ে ছাওয়া একটা রথ রয়েছে। পথে পড়ল পাকা দোলমঞ্চ। অসংখ্য ছোট বড় মন্দির। এই মন্দিরগুলি যেন বৃত্তাকারে ঘিরে ধরেছে গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়িটিকে। জমিদার বাড়ি। মণ্ডল মশায়দের। সেটাকে ডান হাতে রেখে এগিয়ে যেতে গ্রাম পাতলা হয়ে আসে। এদিকে আর বাড়িঘর নেই। ফাঁকা ফাঁকা। বেশ বড় একটা মাঠ পার হয়ে ওদিকে খানকতক চালাঘর দেখা যায়। তার একটা আবার রাণীগঞ্জ টালি দিয়ে ছাওয়া। জিজ্ঞাসা করে জানল ওটাই সাহেবের কুঠি।