সুশীল ভয়ে ভয়ে বলে–খুব মারধর করেছেন বুঝি?
না, এমন আর বেশী কি? ওঁর আক্রোশ মিটাবার আগেই নুরুল মিঞার চাবুকটা ভেঙে গেল যে!
নুরুল মিঞা ওদের ল্যাণ্ডো গাড়ির কোচমান। সুশীল তাকে চেনে। বললে–চাবুক মেরেছেন? আপনাকে?
কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছে নিয়ে চন্দ্রভান বললেন, আমাকে নয়, সূরযকে।
আশ্চর্য শাসন-পদ্ধতি! অগ্নিভান তাঁর সমস্ত আক্রোশ মিটিয়েছেন কনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র সূরযভানের উপর। চাবুকের পর চাবুকের আঘাতে সূরযভান যখন মাটিতে লুটোপুটি খেতে খেতে আর্তনাদ করেছে–ও কাকা আর কখনও করব না, ছেড়ে দাও। তখন চন্দ্রভান দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল দর-দালানের থামের সঙ্গে। কারও সাধ্য হয় নি অগ্নিভানকে বাধা দিতে। চাবুকটা ভেঙে যাওয়ার পর অগ্নিভান একটি পদাঘাত করেছিলেন, তাতে রকের উপর থেকে সূরযভানের মূৰ্ছিত দেহটা গড়িয়ে পড়েছিল উঠানে। অগ্নিভান উঠে চলে গিয়েছিলেন দ্বিতলে। সরকার মশাই পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সূরষের অচৈতন্য দেহটা। চন্দ্রভানের বাঁধনটা খুলে দেওয়ার কথা আর কারও খেয়াল হয় নি!
যুবক সঙ্ঘের অফিস ঘরখানি অতি ছোট। দিনের বেলাতেও যেন আলো জ্বাললে সুবিধা হয়। দরজা খোলাই ছিল। সুশীল আর চন্দ্রভান ঢুকতেই এক ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। এতক্ষণ একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে টেবিলের উপর একখানি খবরের কাগজ বিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি। গতকালকার শহর তোলপাড় করা খবরই বোধহয়। সুশীলকে দেখে বললেন–কি খবর সুশীল? এ কাকে নিয়ে এসেছ?
সুশীল বলল-ইনি আপনাদের যুবক সঙেঘর সভ্য হতে চান কদমদা। এঁর নাম চন্দ্রভান গর্গ। এ বছরই আর্যমিশন থেকে পাস দিয়েছেন। এখন কলেজে পড়ছেন।
ভদ্রলোক চন্দ্রভানের চেয়ে বছর কয়েকের বড়ই হবেন। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে কটকি চটি। কাঁধে একটা ময়লা আলোয়ান। তবু আপনি বলেই কথা বললেন চন্দ্রভানের সঙ্গে, বললেন-বসুন। আমাদের যুবক সঙেঘর নিয়মাবলী দেখেছেন? প্রতিজ্ঞাপত্র দেখেছেন?
চন্দ্রভান তক্তপোশের একপ্রান্তে বসে পড়ে। টেবিল-চেয়ার ছাড়া ঘরে ঐ একখানি তক্তপোশ পাতা। তার উপর মাদুর বিছানো। মাথার কাছে গুটানো একটা ছোট বিছানা। তালপাতার হাতপাখাও আছে একখানা। পিছনের দেওয়ালে ছত্রপতি শিবাজীর ছবি। আরও একখানা ফটো আছে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের। চন্দ্রভান বললেনা, নিয়মাবলী দেখি নি। তবে আপনাদের উদ্দেশ্যের কথা সুশীলের কাছে শুনেছি। আমি সর্বান্তঃকরণে দেশের কাজে নামতে চাই। তবে একটা কথা আমাকে আশ্রয় দিতে হবে। আমি গৃহত্যাগ করে এসেছি।
কদম দাস একটু গম্ভীর হল। বললে, আপনার নামটাই শুনেছি। আপনার পরিচয়?
চন্দ্রভান আত্মপরিচয় দিল।
কদম দাস আরও গম্ভীর হয়ে বলল-কিছু মনে করবেন না। আপনার কাকা একজন প্রভাবশালী বিশিষ্ট জমিদার। আপনাকে আশ্রয় দিতে হলে আমাকে একবার বড়দার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বড়দা, মানে যিনি আমাদের প্রেসিডেন্ট আর কি। ব্রজরাখালবাবু। তিনি হয়তো এখনই এসে পড়বেন।
চন্দ্রভান খবরের কাগজখানা টেনে নেয়। কদম দাস সুশীলের সঙ্গে গল্প করতে থাকে। গতকালকার সভার আলোচনা। কাল নাকি বাগবাজারের মিটিঙে পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছে।
একটু পরেই এসে গেলেন ওদের সভাপতি ব্রজরাখাল রায়। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। গলাবন্ধ আলপাকার কোট আর ধুতি। পায়ে ফিতা বাঁধা জুতো। গালে কুচকুচে কালো চাপ দাড়ি। কদম দাস তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্রজরাখাল বসতে বসতেই প্রশ্ন করেন–আত্মোন্নতি সমিতি থেকে নিবারণ এসেছিল?
না বড়দা। তাঁর আসার কথা আছে নাকি?
হ্যাঁ। একজনকে গ্রামে পাঠাতে হবে। রেভারেণ্ড শারদাঁ একজন কর্মী চেয়েছেন
হঠাৎ চন্দ্রভানের দিকে নজর পড়ায় বলেন–এঁকে? এঁকে তো চিনি না।
কদম দাস চন্দ্রভানের সব কথা বুঝিয়ে বলে।
উপসংহারে বলে, আমি বলেছি, বড়দা রাজী না হলে আমরা কিছুই
কথার মাঝখানেই ব্রজরাখাল বলে ওঠে–এ শুধু ঠাকুরের কৃপা। বাওয়ালীতে কাকে পাঠাব তাই ভেবে মরছি। আর এদিকে ঠাকুর তাঁর কাজ করা লোককে এখানে বসিয়ে রেখেছেন। না হে চন্দ্রভানবাবু, আর দ্বিতীয় কথা নয়। তুমি তৈরী হয়ে নাও। গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে তো?
চন্দ্রভান সবিনয়ে বললে–আমি গ্রামেরই ছেলে। নদে জেলার পাগলাচণ্ডীতে ছেলেবেলা কেটেছে আমার। কোথায় যেতে হবে?
–গ্রামটার নাম বাওয়ালী। হাঁটা পথে মাইল পনের। বজবজের দক্ষিণে। তা নৌকাতেও যেতে পার। অনেকটা পথ চলে যাবে। রাজারামপুরের ঘাটে নামলেই হবে। ওখান থেকে মাইল তিনেক যেতে হবে দক্ষিণ-পূর্বমুখো। সেখানে রেভারেণ্ড আঁরি শারদাঁকে এক ডাকে সবাই চিনবে। উনি একজন পাদরী। তিনিই লোক চেয়েছেন
চন্দ্রভান একটু ইতস্তত করে বলে-কালকেই শপথ নিলাম বিলাতী জিনিস বর্জন করব–আর আজই আপনি আমাকে একজন ইংরাজ ভদ্রলোকের কাছে চাকরি করতে যেতে বলছেন?
ব্ৰজরাখাল কোর্টের বোতামগুলি খুলতে খুলতে বলে–এটা তো বুদ্ধিমানের মত কথা হল না চন্দ্রভানবাবু। প্রথমতঃ, ইংরাজ আমাদের শত্রু নয়, ইংরাজশাসকই আমাদের শত্রু। মার্গারেট নোবলও ইংরাজ, ভুলে যেও না-স্বামীজীর দেহান্তের পর তিনিই আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। দ্বিতীয়তঃ, রেভারেণ্ড শারদাঁ ইংরাজ নন, তিনি ফরাসী। আত্মভোলা মানুষ। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। বাওয়ালীতে উনি খুব ভাল কাজ। করছেন। একটি অনাথ আশ্রম খুলেছেন, তাঁত বসিয়েছেন বাড়িতে। সম্প্রতি একটি ছোটদের বিদ্যালয় খুলেছেন তার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। তুমি চাকরি করতেও যাচ্ছ না, যাচ্ছ বাওয়ালী গ্রামে দেশসেবা করতে।