গানের গলা চার বন্ধুর কারও নেই–একমাত্র ব্যতিক্রম গগন পাল। সুরেলা কণ্ঠ তার। ওদের সকলের হয়ে একাই সে সারাদিন গান গাইল।
এ ওর হাতে রাখী বেঁধে দেয়–ও এর হাতে।
বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে ওরা কবন্ধু চলে এল আপার-সার্কুলার রোডে। এখানে বঙ্গ-ভবন স্থাপনের উদ্দেশ্যে সভা হওয়ার কথা। সভাপতিত্ব করতে এলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা আনন্দমোহন বসু। তিনি তখন রোগশয্যায়। রোশয্যায় নয়, আসলে মৃত্যুশয্যায়; কারণ এই রোগভোগের অল্পকাল পরেই তিনি অমর ধামে চলে যান। আরামকেদারায় করে সভাপতিকে সভামঞ্চে নিয়ে আসা হল। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস-চ্যান্সেলার স্যার গুরুদাস সভাপতি বরণ করলেন। সভায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। অন্তত পঞ্চাশ হাজার লোক সভাপতি বরণের সঙ্গে সঙ্গে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিল। আনন্দমোহন রোগশয্যায়, তাই তাঁর ভাষণটি বজ্রকণ্ঠে পড়ে শোনালেন সুরেন্দ্রনাথ। অভিভাষণ পাঠের পর আনন্দমোহনের স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র পড়ে শোনানো হল। ইংরাজিতে সেটি পাঠ করলেন স্যার আশুতোষ চৌধুরী এবং বাঙলায় সেটি পাঠ করে শোনালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ গল্প থামিয়ে দ্বৈপায়ন-দাদু বলেন, সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম। আমার বয়স তখন ষোলো, রবীন্দ্রনাথের চুয়াল্লিশ।
আমি বলি-তারপর?
তারপর সন্ধ্যায় আমরা সবাই দল বেঁধে চললাম বাগবাজার স্ট্রীটে। পশুপতি বসু মশায়ের বাড়িতে। কর্মসূচী অনুসারে এখানেই স্বদেশী কাপড় তৈরী করার জন্য ভাণ্ডার খোলা হবে। আমাদের হেঁটে যেতে হয় নি। ভীড়ের চাপে আপনা থেকেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বাগবাজারে। জনসমাবেশ লক্ষাধিক হয়েছিল। সে আমলে এ একটি রেকর্ড। সভায় স্থির হল, স্বদেশী বস্ত্র তৈরীর জন্য একটি ভাণ্ডার স্থাপন করা হবে। যার পকেটে যা ছিল সবাই দান করল। আমাদের কাছে বিশেষ কিছুই ছিল না । কিন্তু চন্দ্রভানের হাতে ছিল একটি আংটি। কবছর আগে উপনয়নের সময় পেয়েছিল। হাত থেকে খুলে সেটিই সে ফেলে দিল ভিক্ষাপাত্রে।
সব মিটতে সেই যার নাম রাত দশটা।
সমস্ত দিন অভুক্ত আছি। নিরম্বু উপবাস। ক্লান্ত দেহে টলতে টলতে সবাই বাড়ি ফিরে এলাম। অন্যের কথা জানি না, আমি তো বিছানায় পড়েই মড়ার মত ঘুমিয়ে পড়ি। কদিন পরে খবর পাওয়া গেল চন্দ্রভান বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
খবরটা শুনেছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। এমন সাহস নেই যে, ওদের বাড়িতে গিয়ে যাচাই করে আসি। খবরটা জানিয়ে গেল সুশীল। ঐ সুশীল সেন।
পরদিন সকালেই নাকি চন্দ্রভান চলে এসেছিল সুশীলদের বাড়িতে। চোখ দুটো লাল, মুখখানা থমথম করছে। সুশীল অবাক হয়ে বলে-কী হয়েছে চন্দরদা? অসুখ করেছে আপনার?
চন্দ্রভান বলেছিল-সুশীল, সেদিন তুই যুবক সঙ্ঘের কথা বলছিলি। ওদের আস্তানাটি কোথায় জানিস?
–কেন জানব না? গোলদিঘির ধারে। কতবার গিয়েছি সেখানে। কেন চন্দরদা?
–তুই আমাকে সেখানে নিয়ে চল। পথে কথা হবে।
সুশীল যেমন ছিল বেরিয়ে আসে। পথে নেমে প্রশ্ন করে কি হয়েছে চন্দরদা?
–আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি সুশীল। আর ওবাড়িতে ফিরব না। তুই সেদিন বলেছিলি যুবক সঙ্ঘে অনেক ছেলে কাজ করে। ওরা থাকতে দেয়, খেতে দেয়। আমি ওদের দলে নাম লেখাব।
–সে কী? আর কোনদিন বাড়ি ফিরবেন না?
না!
সূরয কোথায়? সে জানে?
সূরয বেঁচে আছে কিনা তাই জানি না!
পথের মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল সুশীল। চন্দরদার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?
সমস্তটা শুনে অবশ্য বুঝতে পারে চন্দ্রভানের মস্তিষ্কবিকৃতি হয় নি আদৌ। দুরন্ত অভিমানে সে তার পরিচিত দুনিয়ার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। গতকাল সূর্যোদয়ের আগেই দু-ভাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে–সেসব কথা তো সুশীল জানেই। সেও ছিল দলে। সারাদিন ওরা পথে পথে ঘুরেছে। বন্দেমাত্রম করেছে, গান গেয়েছে আর সভায় জয়ধ্বনি করেছে। চন্দ্রভান জানতে পারে নি, সকালের দিকেই পাগলাচণ্ডী থেকে অগ্নিভান এসেছিলেন তাঁর কলকাতার বাড়িতে। উনি বড় একটা কলকাতায় আসেন না। তবে নাকি এ বছর সরকারী খেতাব পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে–তাই কলকাতায় এসে কিছু তদবির-তদারক করে যেতে এসেছেন। ওঁদের কলকাতার বাড়িতেও অরন্ধনের ব্যবস্থা হয়েছিল। জমিদার-মশাই এসেই ব্যবস্থাটা পালটে দিলেন। সব বাজার বন্ধ। শুনে অগ্নিভান ক্ষেপেই আগুন। শেষ পর্যন্ত সরকার মশাই ফিরিঙ্গি পাড়ার হগ সাহেবের বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন কাঁচা আনাজ। উনান জ্বলেছে, খানা পাকানো হয়েছে। কিন্তু রাজপুত্রেরা কোথায়? গৃহ শিক্ষক মথুরাবাবু আমতা-আমতা করে বলেছিলেন তিনি ঠিক জানেন না। সরকার মশাইও যখন বললেন চন্দ্রভান আর সূরযভানের অবস্থান সম্বন্ধে তিনিও কোন খবর রাখেন না তখন বোমার মত ফেটে পড়েছিলেন অগ্নিভান। হুকুমজারি করেন–যেখান থেকে পার, ধরে নিয়ে এস ওদের!
সমস্ত দিন চাকর, দারোয়ানের দল সারা কলকাতা চষে বেড়িয়েছে। বিডন স্কোয়ার থেকে বাগবাজার। কিন্তু সে জনারণ্য থেকে কেমন করে খুঁজে বার করবে ওদের? একপ্রহর রাত করে দুই রাজপুত্র যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন অগ্নিভানের সমস্ত দিনের নিরুদ্ধ আক্রোশ ফেটে পড়েছিল!